প্রফেসর তপনজ্যোতি বড়ুয়া, সত্যিকার অর্থে তাঁর মতো এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি মননে, চিন্তাশীলতায়, উঁচুদরের ভাবনায়, সংগীত মনস্কতায় একটি ঈর্ষণীয় স্থানে বসবাস করতেন সর্বদা। এতবড়ো মানুষের সম্পর্কে লেখা অন্তত আমার মতো নিতান্ত সাধারণ কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে সঠিক মূল্যায়ন না হয়ে অবমূল্যায়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সমধিক।
সাংগঠনিক কারণে তাঁর আসকার দিঘির পাড়ের বাসায়, এরপরে কাজীর দেউড়ির বাসায়, সর্বশেষ চট্টগ্রাম কলেজের পাশে তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে আলাপ হয়েছে। আলাপে সাংগঠনিক চিন্তাভাবনা, নতুন নতুন উদ্ভাবনা নিয়ে কথা হয়েছে। সংগঠনে (সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসংগীত পরিষদ বাংলাদেশ) অনেকেই ছিলেন। কিন্তু আমার মাথায় নতুন নতুন ভাবনা যা আসত সবই তাঁর সামনে উপস্থাপন করতাম। এতে তিনি ভালোদিক, মন্দদিক উভয়টাই তুলে ধরতেন। এখানে উল্লেখ করবার মতো বিষয় হল যে, আলোচনার সময় তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জাদরেল শিক্ষক এটি কখনোই প্রকাশ পেতনা। সদারঙ্গের বছরব্যাপী কার্যক্রমে তাঁর চিন্তার বহু ফসল কার্যকরী হয়েছে।
অধিক প্রচলিত নাম ‘সদারঙ্গ’ (আসল নাম ‘উস্তাদ নিয়ামত হোসেন খাঁ’), খেয়াল গানের বর্তমান রূপ তিনিই দিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর বাসনায় আমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নাম রেখেছিলাম সদারঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিষদ বাংলাদেশ। প্রফেসর তপনজ্যোতি বড়ুয়া সংগঠনে যুক্ত হয়েই বললেন, যেহেতু সংস্কৃতি শব্দটির অর্থ ব্যাপক, আর এই সংগঠনের কাজ মূলত উচ্চাঙ্গসংগীত বিষয়ক এক কেন্দ্রিক, সেহেতু এই সংগঠনের নির্দিষ্ট নামকরণ হওয়া উচিত। তিনি এই সংগঠনের নতুন নামকরণ করলেন সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসংগীত পরিষদ বাংলাদেশ।
একবার তিনি বললেন, ‘আমাদের উপমহাদেশীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের বহু প্রাতঃস্মরণীয় সংগীত মনীষী রয়েছেন যাঁদের পরিচয় বর্তমান অবক্ষয়িত সমাজে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা আমাদের প্রতি বছর বাৎসরিক উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনগুলো এক এক সংগীত মনীষীর স্মরণে করতে পারি। সেই থেকে প্রতি বছরের সম্মেলনে এক এক মনীষীকে স্মরণ করার রীতি চালু হল। বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালায়ও বহু নতুন সংযোজন করেছেন তিনি। তাঁর বাসায় গেলে আড়াই ঘন্টা থেকে তিন ঘন্টার আগে আলোচনা শেষ হতো না।
আলোচনায় আমার উঠতি এবং সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীদের নাম করে এক একজনের কার কতটুকু উন্নতি হচ্ছে এসবের খবর নেওয়া যেমন থাকত, তেমনি কিছু উচ্চাঙ্গ কণ্ঠ সঙ্গীত ও কিছু যন্ত্র সঙ্গীতের নতুন সংগ্রহ জমা করে রাখতেন আমি গেলে একসাথে শোনা এবং সেই বিষয়ে আলোচনার জন্য। আলোচনায় আমি বেশিরভাগ সময় শ্রোতা হয়ে থাকবার চেষ্টা করতাম। কারণ,তাঁর প্রশ্নগুলোর যদি সঠিক উত্তর দিতে না পারি সেই ভয়ে। তবে শিখে নিতাম যখন যা শুনছি। শুনতে শুনতে একসময় আমার মনে হল, সেই অর্থে গান-বাজনা না শিখে শুধুমাত্র শুনে শুনেই সঙ্গীতের এমন একটা স্তরে নিজেকে নিয়ে যাওয়া সেটির উদাহরণ আমার দেশে খুব বেশি নেই। এটি শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির উপর ভিত্তি করেই সম্ভব হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার মেধাবী এই ছাত্রটির কথা প্রসঙ্গে প্রকাশ হল, ‘বর্তমান সময়ে মেধাবী যারা তাদের লক্ষ্য থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু আমাদের সময় তা ছিলনা। যেমন, আমি ঠিক করলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ব। আমাদের ব্যাচের বেশ কিছু শেষের দিকের ছাত্রদের কেউ কেউ ডাক্তারি পড়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ মননশীল ও মেধাবী মুষ্টিমেয় শিক্ষকের একজন ইংরেজি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক প্রফেসর তপনজ্যেতি বড়ুয়া বাংলা সাহিত্যেও তাঁর অসামান্য দখল সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক প্রাজ্ঞজনেরা অবগত আছেন। তাঁর বক্তব্যের বাক্য চয়নে, লেখার সাবলীল প্রকাশ অথচ তার গভীরতায় মুগ্ধ হয়েছি আমরা মতো সাধারণ জনগণও।
এমন ব্যক্তি তাঁর জীবনের প্রৌঢ়ত্বে এসে সাহিত্যের জগত থেকে যেন বিদায় নিলেন স্বেচ্ছায়। একমাত্র আশ্রয় খুঁজে নিলেন সঙ্গীতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাসে একটি অলিখিত নিয়ম আছে। শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা প্রবীণ তাঁদের সম্মানে তাঁদের জন্য বাসের সম্মুখ ভাগ বরাদ্দ থাকে আর আমার মতো কম বয়সীরা বসতেন পেছনের দিকে। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নব প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসাবে এই বাসে যাওয়া আসা করছিলাম তখন অলিখিত নিয়ম অনুসারে বাসের পেছন দিকটায় গিয়ে বসতাম। আর তিনি বসতেন বাসের সম্মুখভাগে। বসেই তিনি পেছন দিক থেকে আমাকে ডাকতেন সামনে গিয়ে তাঁর পাশের সিটে বসার জন্য। এতে বিব্রত বোধ করলেও তাঁর ডাকে সাড়া দিতেই হতো। সেখানেও আলোচ্য বিষয় থাকতো সঙ্গীত, সেই আলোচনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম শহরের বাসার কাছে না নামা পর্যন্ত।
তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতের এমন উঁচু মাপের শ্রোতা ছিলেন যে কোনো রাগের সামান্য কিছু শুনলেই সেটি কোন রাগ তার নাম বলে দিতে পারতেন সঙ্গে সঙ্গেই। প্রচলিত কয়েকটি রাগ ছাড়া এত পরিমাণ রাগের পরিচিতি খুব কম সংখ্যক শিল্পীরই আছে। শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গসংগীতের কথাইবা বলি কেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন, ছিলো লঘুসঙ্গীতের স্বর্ণালি দিনের (এমনকি চলচ্চিত্রের গানও) বিখ্যাত গানগুলোর সাথে তাঁর অবিচ্ছেদ্য টান। নূর জাহান, আঙ্গুরবালা, বেগম আক্তার, গীতা দত্ত প্রমুখের সাথে লতা মঙ্গেশকরের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত অনুরাগী ছিলেন তিনি। লতা মঙ্গেশকরের ছোটবেলা থেকে শুরু করে তাঁর পরিণত বয়সের গানসহ খুব কম সংখ্যক আছে যা তাঁর জানা নেই।
প্রচারবিমুখ এবং নিভৃতচারী এই মানুষটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসারত ছিলেন। গতকাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। আমি মহান স্রষ্টার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, সঙ্গীত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়