নাসিম আলী খান : গানে, সুরে নিবিষ্ট এক সংগীতশিল্পী

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | বৃহস্পতিবার , ৩ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

একজন শিল্পীর মন সর্বদাই নতুনত্ব খোঁজে। আধুনিকতার সন্ধানে নতুন নতুন ভাবনায় সুর, তাল, লয় সৃষ্টি করে দর্শক – শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেন। এবং তা যদি ক্লিক করে যায়, তাহলে তো ্তুহিট্থ-এর তকমা লেগে যায়।

সেই কবে, ১৯৭৮ সাল থেকে সোলস-এর হয়ে ইংরেজি গান গাইতেন তিনি আন-অফিসিয়ালি। পরে ১৯৮০ সালে থেকে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগ দিলেন সোলস-এ। তারপর তো ইতিহাস। বলছিলাম : নাসিম আলী খানের বিষয়ে। তিনি মূলত ইংরেজি গান গাইতেন। এখনো গেয়ে চলেছেন।

আশির দশকে ঝাঁকড়াচুলের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের এক উচ্ছ্বল তরুণ শুদ্ধ ইংরেজিতে গান গাইছেন মঞ্চে, বিটিভি-তে। আর তারুণ্য মেতে উঠতে সময় নেয়নি। সেই নাসিম আলী খান মানেই একরাশ মুগ্ধতা। উচ্ছলতা।

মনে আছে আজও, ১৯৮৪ সালে আমরা তখন কলেজে পড়ছি। তখন সারা বিশ্ব কাঁপছে মাইকেল জ্যাকসনের Just Beat It গানে। সেই বছর ঈদের আনন্দমেলায় নাসিম আলী খান নাটকীয়ভাবে গাইলেন Just Beat It . ব্যস, পরদিন তো কলেজে ঐBeat It,  Just Beat It – ছাড়া কোনো কথা নেই। কেমন করে গাইলেন এত কঠিন গান? তখন তো নাসিম আলী ভাইকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ কই? তিনি তো তখন তারকা।

শুরুতেই একটি কথা বলেছিলাম যে, শিল্পীমন সর্বদা নতুনত্ব খোঁজে। নাসিম আলী ভাইও নতুনত্বের খোঁজে ইংরেজি গানের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সরাসরি বাংলা গানে। সোলস-এর এলবামে গাইলেন বক্তব্যধর্মী গান :

“আণবিক আঘাতে

হিরোশিমা কাঁদে

বিপন্ন নাগাসাকি

বিবেকের ডাকে এসো এক বাঁকে।”

বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথায় নাসিম আলী ভাই নিজেই সুর করে গাইলেন।একেবারেই ভিন্ন আঙিকের গান।

নাসিম আলী ভাই অবশ্য বরাবরই গতানুগতিক প্রেমের গান গাইতে চান না। গানের মাধ্যমে একটি বার্তা সমাজকে দিতে চান, যাতে উদ্বুদ্ধ হয় সমাজ। তাই তাঁর অন্যান্য বাংলা গানে তারই প্রভাব দেখি। ১৯৮৬ সালে তাঁর একক এলবাম এলবাম রিলিজ হয়। এবং যথারীতি হিট। সেই এলবামের গান, আজও শুনি মুগ্ধ হয়ে। যেমন একটি গান আছে :

“যতিন স্যারের ক্লাসে

আড় চোখে তাকিয়েছিলে

আমি ভেবেছিলাম সেই তাকানোতে

কিছুটা অনুরাগ কিছু ভালোবাসা ছিল।”

গানটির বিষয়বস্তু বেশ মজার।

তাঁর গাওয়া আরও একটি গান মনে পড়ে আজও।

“ভালোবাসি ঐ সবুজ মেলা

প্রাণ জুড়ানো তার শ্যামলছায়া

মন মাতানো বাঁশির সুরে

প্রিয় লোকালয় আসে ফিরে।”

ইংরেজি গানের পাশাপাশি বাংলা গানেও সমান পারদর্শী নাসিম ভাই। এটাই আমার তাঁর প্রতি মুগ্ধতা। এক বিকেলে নাসিম আলী খানের বাসায় দীর্ঘসময় আলাপচারিতার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অসাধারণ মুহূর্ত কাটালাম। যে মানুষটির গান শোনা ও একনজর দেখার জন্য ভীড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করেছি, আজ সেই প্রিয় গায়কের সামনে বসে তাঁর সংগীত ভাবনা, দর্শন নিয়ে আলাপে মেতে উঠি।

নাসিম আলী খানের ব্যক্তিগত কিছু তথ্য:

জন্ম: ১ জুলাই ১৯৬১

বাবা নওশের আলী খান। ব্যবসায়ী।

(তিনি বাইশ বছর যাবত আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন)

বাবা নওশের আলী গান গাইতেন। বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কলীম শরাফীর সাথে গান গাইতেন। ছয় ভাই ও দুই বোন। নাসিম আলী আলী হচ্ছেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট জন।

পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রেই গান, সুর, তাল, লয় – ইত্যাদি তাঁর পাওয়া।

সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে, ভাইরা যখন পড়তেন, পাশে বসে নাসিম আলী তা দেখে দেখে এঁকে ফেলতেন। তাই অ, আ, ই, ঈ, অ, ই, ঈ, উ ইত্যাদি নিজে নিজেই লিখেছেন ও শিখেছেন। আর পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতায় ছবি আঁকা।

নাসিম আলী ভাইয়ের স্টাডি রুমটি বেশ পরিপাটি। দেওয়ালে বেশ কয়েকটি আঁকা ছবি। প্রথমে ভেবেছিলাম, অন্য শিল্পীর হবে। পরে তিনিই বললেন, এগুলো সবই আমার আঁকা। অপূর্ব। বিস্ময়ের পারদ বাড়তেই থাকে। গান শেখার জন্য কোন ওস্তাদ ছিল না। বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিজের চেষ্টায় শিখেছেন। সুরও সৃষ্টি করছেন মনের ভেতর থেকেই।

নাসিম আলী ভাই বললেন: মানুষ যে চিন্তা করে, সেটাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সাধনা। সেই সাধনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গানে, সুরে, ছবি আঁকায়, লেখায়। আমরা যেটা creations বলছি, সেটা তো আত্মার মধ্যেই মানবাত্মার মধ্যেই আছে। তুমি, আমি – যে মাধ্যমেই চর্চা করি না কেন, আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত থাকতে হবেই। নতুবা সৃষ্টি হবে না। আল্লাহ তায়ালার মধ্যেই সকল কিছুই নিহিত। তুমি যতটুকু পারো, রসদ নাও। সৃষ্টি করো। মানুষকে দাও। অনেক শান্তি। আমি অবসরে ছবি আঁকি। আমার মনের নানান বিক্ষুব্ধ কিংবা ভালোবাসাকে আঁকি। আবার গানও লিখি। সুর করি। আমার এই স্টাডি রুমএ গিটার থাকে সবসময়ই। কাজের ফাঁকে গান গাই। সুর তুলি।

শান্তি পাই।

সুদীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। কম সময় নয়। অনেক স্মৃতিময় মুহূর্ত পেরিয়ে এসেছেন। সোলস তাঁকে যেমন গায়ক, সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তিনিও নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন।

বিটিভিতে গান গাওয়া নিয়ে ১৯৮০ সালের একটি মজার স্মৃতি আছে নাসিম আলী খানের। যেটি আবার আমায় বলেছিলেন আরেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, সুরকার, ড্রামার শাহবাজ খান পিলু ভাই। সেই ঘটনাটি নাসিম আলী ভাইকে বলতেই খুব হেসে নিলাম আমরা। ঘটনাটা ছিলো এমন: (নাসিম আলী ভাইয়ের জবানীতে শুনি)

“সেবার আমরা সোলস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিটিভিতে গিয়েছি গান গাইতে। যথারীতি বাংলা গান রেকর্ড করার পর বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমার গান? আমি তো ইংরেজি গান গাইবো। চট্টগ্রাম থেকে এত সুন্দর জামা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছি সবাইকে বলেছি। কিন্তু বিটিভি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিচ্ছে না। পরে অনেক অনুরোধের পর বলা হলো: ঠিক আছে, আগে অডিও রেকর্ড করে শোনাও। আমি ইংরেজি গানটি গাইলাম। শুনে কর্মকর্তারা বললেন, আরে এটি তো বিদেশি শিল্পী। তখন পিলু ও অন্য সদস্যরা বললো: এই গানটিই তো নাসিম আলীর কণ্ঠের। তখন তো ওরা তাজ্জব। পরে সানন্দে রাজী হয়ে আমার গান রেকর্ডিং হলো। আমি গেয়েছিলাম : ও খড়াব ণড়ঁ গড়ৎব ঞযধহ ঈধহ ও ঝধু…

এভাবেই এগিয়েছে সময়। প্রায় পঞ্চাশটির মত একক গান আছে। দুটো একক এলবাম। তাছাড়া সোলস-এর প্রকাশিত এলবামে গান তো আছেই।

আর এখন ‘নাসিম আলী খান প্রজেক্ট’ নামে আরেকটি মিউজিক প্ল্যাটফর্ম চালু করেছেন। নাসিম আলী ভাই অতি সমপ্রতি তাঁর লেখা এই গানটি সুর করেছেন এবং গাইলেন :

A time when hearts were open wide,

We stood together, side by side,

The world was kind, the skies were clear,

We shared our hopes, we shared  our tears.

 

But somewhere deep, the lights went dim,

We lost our way,  in  darkness within

Now Cries and scream horrors of  the night,

Humanity pleads spare the child’s life

Chorus

Rise up,  our voices be heard,

facing the storm, we’ll spread the word,

up from the  ashes, together we’ll pray,

Stop this  killing  this very day.

নাসিম আলী খান আপাদমস্তক আধুনিক মনস্ক। সমসাময়িক ঘটনাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। ফলে সামপ্রতিক ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয়, অবুঝ শিশুদের দুর্দশা তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। এমনতর সবকিছুকে নিয়ে বীরদর্পে সংগীত ভুবনে সরগম করার জন্য হাজির হচ্ছেন নিয়মিত “নাসিম আলী খান প্রজেক্ট” -এর মাধ্যমে। আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম। সবশেষে সবিনয়ে বলি: নাসিম ভাই, আপনার কাছে আমরা শ্রোতারা, আরও অনেক কিছু পেতে চাই। মহান আল্লাহ তায়ালা আপনার মঙ্গল করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম
পরবর্তী নিবন্ধলাভ বা ক্ষতি কতটুকু!