সাত বছর চার মাস পর পূর্ণাঙ্গ করা হলো ছাত্রদলের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি। এতে নতুন করে ২৭২ জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদল পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয়। এর আগে ২০১৩ সালের ২১ জুলাই ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে একজন মারা যান। বাকি দশজনের নয়জনই যোগ বিএনপিসহ অন্য অঙ্গসংগঠগুলোতে যোগ দেয়। এছাড়া ২০১৫ সালেই মেয়াদ চলে যায় আংশিক কমিটির। এদিকে গতকাল ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সিনিয়র-জুনিয়র মানা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠেছে। কমিটি গঠনের সাথে জড়িতরা ‘আর্থিক লেনদেন’ করায় এমন হয়েছে বলে দাবি করেছেন ছাত্রদল নেতারা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন দলীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকলেও অনেককে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ ছাত্রশিবিরের কর্মী ও ব্যবসায়ীদের পদ দেয়া হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন পর কমিটি হলেও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে। ক্ষুব্ধ ছাত্রদল কর্মীরা গতকাল রাত ৮টার দিকে আগুন দিয়েছে নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয়ে। এসময় তারা বিক্ষোভ মিছিল করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘোষিত কমিটির সহ-সভাপতি সৌরভ প্রিয় পালের অনুসারিরা তালা ভেঙ্গে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এসময় একটি টেবিল ও ব্যানার কার্যালয়ের বারান্দায় এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পার্শ্ববর্তী ভবনের বাসিন্দারা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৌরভ প্রিয় পাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, সিনিয়-জুনিয়র না মানায় অসন্তোষ আছে। সহসা এ কমিটি ভেঙ্গে নিয়মিত ছাত্রদের সমন্বয়ে কমিটি করতে হবে।
আরেক সহ-সভাপতি জসীম উদ্দিন হিমেল বলেন, সিনিয়রদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই তাদের মাঝে ক্ষোভ আছে। নগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বুলুও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কিছুদিন পর কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি করা হবে।
পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতা সাইফুল ইসলাম সেজান দৈনিক আজাদীকে বলেন, একসময় ছাত্রলীগ এবং ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন, তাদেরও কমিটিতে রাখা হয়েছে। কিন্ত ১৩ বছর ধরে রাজনীতি করে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলা-হামলার শিকার হয়েও কমিটিতে স্থান পাইনি। নগর সভাপতি গাজী সিরাজ-বেলায়েত হোসেন বুলু আর্থিক লেনদেন করে কমিটি করায় অনেক ত্যাগীর মূল্যায়ন হয়নি। আবার তারা বলছেন, দলের হাইকমান্ডই কমিটি চূড়ান্ত করেছে। তাই আমার প্রশ্ন টাকা কি তাহলে হাই-কমান্ড খেয়েছে?
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহ বলেন, ‘কমিটিতে তো আমার স্বাক্ষর নাই। এটা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। তারাই বলতে পারবেন কেন কমিটিতে ত্যাগী কয়েকজন নেতাকে রাখা হয়নি। কিছুদিন আগে আংশিক কমিটির ১০ জনের কাছে নামের তালিকা চেয়েছিল কেন্দ্র। প্রত্যেকেই জমা দিয়েছে। কেন্দ্র সেখান থেকে বাছাই করতে গিয়ে বাদ দিয়ে ফেলেছে এবং সিনিয়র-জুনিয়র ঠিক রাখেনি। কিন্তু তারা যদি নগর-সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সাথে বসে কমিটি ঠিক করতেন তাহলে সিনিয়র-জুনিয়র ঠিক না থাকার বিষয়টি হতো না। তারপরও দীর্ঘদিন পর কমিটি হওয়ায় অনেক ত্যাগীর মূল্যায়ন হয়েছে। যারা বাদ পড়েছেন তাদের সংযোজন করার জন্য আহবান জানাবো কেন্দ্রকে।
১০ জনই অন্য কমিটিতে :
২০১৩ সালে ঘোষিত আংশিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক জালাল উদ্দিন সোহেল ২০১৭ সালের ১৭ মে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এছাড়া সভাপতি গাজী মোহাম্মদ সিরাজ উল্লাহ যোগ দেন বিএনপিতে। তিনি বর্তমানে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বুলু বর্তমানে নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম রাশেদ বর্তমানে নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি পদে আছেন। এছাড়া নগর ছাত্রদলের চারজন সহসভাপতি যথাক্রমে মঈন উদ্দিন শহীদ বর্তমানে নগর বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক, ফজলুল হক সুমন নগর যুবদলের সহসভাপতি ও জিয়াউর রহমান জিয়া নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। নগর ছাত্রদলের চার যুগ্ম সম্পাদক যথাক্রমে জমির উদ্দিন নাহিদ স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক, আলী মর্তুজা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ও মোশাররফ হোসেন যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু সহসভাপতি জসিম উদ্দিন চৌধুরী গতকাল পর্যন্ত অন্য কোন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন নি।
অত:পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি :
গত জুলাই মাসে নগর ছাত্রদলের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এজন্য ৩২৬ জনের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করে কেন্দ্র। ওই সময় কেন্দ্রীয় নেতারা সিদ্ধান্ত নেয়, ‘বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে ৩১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হবে। কমিটিতে বিবাহিত ও ২০০০ সালের পূর্বে যারা এসএসসি পাস করেছে তাদের বাদ দেয়া হবে। এরপর এ আহবায়ক কমিটি তিন মাসের মধ্যে ২০০৩ সাল থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ এবং অবিবাহিতদের দিয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবে।’
তখন বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আন্দোলন শুরু করে ছাত্রদলের বিবাহিত নেতারা। কমিটিতে রাখার দাবিতে ১৫ জুলাই নগর বিএনপির সভাপতিসহ শীর্ষ নেতাদের প্রায় দেড় ঘন্টা দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরবর্তীতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ সিনিয়র নেতাদের স্মারকলিপিও দেন। গণস্বাক্ষরও সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে গত অক্টোবর মাসে ২০০৫ সালে যারা এসএসসি পাশ করেছে এবং অবিবাহিতদের নিয়ে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু সেটিও আটকে যায়।
সর্বশেষ গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা দেন, সব কর্মীকে যেন মূল্যায়ন করা হয়। এরপ্রেক্ষিতে ছাত্রদলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় টিম নগর কমিটিকে গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় জরুরি তলব করে। ওইদিন বিএনপি চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে বৈঠক করেন তারা। এতে সিদ্ধান্ত হয়, ‘স্বল্পসময়ের জন্য বিদ্যমান কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করা হবে। সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে এ কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহবায়ক কমিটি করা হবে। ওই আহবায়ক কমিটিতে বিবাহিতদের স্থান দেয়া হবে না।’ এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই গতকাল আংশিক কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করা হয়।