নাসা : আমেরিকান গর্বের প্রতীক

শঙ্কর প্রসাদ দে | শনিবার , ২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

মোটামুটি গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ গবেষণা এগিয়ে নিচ্ছিল। আমেরিকান সমাজে কানাঘুষা চলছিল, রাশিয়ানরা কিছু একটা করতে যাচ্ছে ৪ অক্টোবর ১৯৫৭ কোল্ড ওয়ার সময়কাল বলে কথা। সাপ নেউলের শত্রুতাকে হার মানিয়েছিল রুশমার্কিন বৈরিতা। ভোরের হালকা আলো ভেদ করে দৌড় লাগালো মানুষের তৈরি প্রথম রুশ কৃত্রিম উপগ্রহ। অস্থির হয়ে পড়ল মার্কিন আপামর জনতা। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার নির্দেশ দিলেন রাখো তোমাদের সুপারসনিক রকেট গবেষণা। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঘঅঈঅ অর্থাৎ ন্যাশনাল এডভাইজারী কমিটি ফর এরোনটিকস্‌ বাতিল করে প্রতিষ্ঠিত হয় ঘঅঝঅ অর্থাৎ ন্যাশনাল এরোনটিকস এন্ড স্পেস এডমিনিট্রেশন ১লা অক্টোবর ১৯৫৮। এটি এমন একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান, সরকার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করলেও সংস্থার কাজকর্মে সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান খবরদারি করে না।

১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টা। পৌঁছে গেলাম ওয়াশিংটনস্থ নাসার সদর দফতরে। ছিমছাম সিম্পল ৫/৬ তলা একটি বিল্ডিং। জৌলুষ নেই, বাহার নেই, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলীও চোখে পড়ল না। আসলে সদর দফতরে উৎক্ষেপণ ও গবেষণা কেন্দ্রের দাপ্তরিক সমন্বয়, কর্মচারীদের বেতন ভাতা, নানাবিধ ব্যয় অনুমোদন বিষয়েই দেখভাল করা হয়। উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলো হল () জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার () কেইপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন () ভ্যান্ডেনবার্গ এয়ার ফোর্স বেইজ। সব’চে বেশি উৎক্ষেপন হয় কেনেডী স্পেস সেন্টার থেকে, আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম চৌকষ, জনপ্রিয় ও সুদর্শন প্রেসিডেন্ট কেনেডীর প্রবল উৎসাহের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর জীবদ্দশাতেই এটি ১ জুলাই ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আটলান্টিকের কোল ঘেঁষে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মেরিট এলাকাটি একাধারে আদর্শিক, প্রকৃতিক নৈসর্গমণ্ডিত ও যুৎসই। প্রায় বসতিহীন দ্বীপটি হয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীর অভয়ারন্য। ১৬ জুলাই ১৯৬৯ তারিখে এই স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটার্ন ফাইভ উৎক্ষেপণ যান থেকে এপোলে ১১ চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

স্পেস ফোর্স স্টেশন মূলত বিমান বাহিনীর একটি সামরিক ইউনিট। কেনেডী সেন্টারের পার্শ্ববর্তী দ্বীপ ক্যাপ ক্যানভেরাল। এই উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে প্রতিবছর উৎক্ষেপিত হয় কোন না কেন উপগ্রহ। পরবর্তীতে শনি, বুধ, শুক্র, মঙ্গল গ্রহকে ফ্লাইবাই করা মহাকাশ নভোযানগুলো উৎক্ষেপনের আদর্শ স্থান। ১৯৭৭ সালে আন্তনাক্ষত্রিক নভোযান ভয়েজার২ ও ভয়েজার ১ উৎক্ষেপিত হয়েছে এই স্টেশন থেকে। তৃতীয় উৎক্ষেপন স্টেশনটির নাম ভ্যান্ডেনবার্গ স্পেস ফোর্স স্টেশন। ১৯৪১ সালে ভ্যান্ডেনবার্গ বিমান ঘাটিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে নাসা এটিকে ব্যবহার করে মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। মহাকাশে মানব উপস্থিতির সম্ভাব্য শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা ও অন্যান্য টেকনিকাল বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। এখনো সচল অথবা আয়ুস্কালের শেষ প্রান্তে এসে পৌছা মহাকাশ স্টেশনটি নির্মিত হয়েছিল এই উৎক্ষেপণ স্টেশনকে ব্যবহার করে। নভোচারীরা হরহামেশাই এই স্টেশন থেকে পাড়ি দিচ্ছেন মহাকাশ স্টেশনে।

নাসার সব’চে গৌরবজনক দিক হলো, বর্তমানে এটি অন্য দেশের স্পেস এজেন্সীগুলোর জন্য নিজেদের উম্মুক্ত করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা আমেরিকা এসে মহাকাশের উপর প্রয়োজনীয় কোর্স সম্পন্নের পর নাসার বিভিন্ন প্রজেক্টে ঢুকার সুযোগ পায়। এইতো গত ডিসেম্বরে নাসার পরিচালক বিল নেলসন ভারত সফরে এসে ইসরো পরিদর্শন করেন এবং ইসরোর সাথে যৌথভাবে উপগ্রহ উৎক্ষেপন, মহাকাশ স্টেশন ও চন্দ্রাভিযানের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। খুশীর বন্যা বয়ে গেছে ভারতীয় বিজ্ঞান মনস্কদের মাঝে। ইসরো প্রধান মি: সোমনাথ ২ জন ভারতীয় নভোচারীকে মহাকাশ স্টেশনে প্রেরণের আগ্রহ প্রকাশ করলে মি: নেলসন তা সাদরে গ্রহণ করেন।

নাসার সাথে ইউরোপীয়, জাপান, চীন, ইসরাইল, ফ্রান্সের যৌথ প্রকল্প এই শতাব্দীর শুরু থেকে প্রবল, এখন যোগ হয়েছে ভারত। ভারতীয় ছেলেমেয়েরা এখন মঙ্গল আর চাঁদে যাবার স্বপ্নে বিভোর। এতোক্ষণ পৃথিবীব্যাপী সরকারী মহাকাশ সংস্থাগুলোর কথা বললাম। সর্বশেষ বিষ্ময়ের জন্মদাতা হলেন ‘স্পেস এক্সের’ এলেন মাঙ। এই ভদ্রলোক গলা ফাটিয়ে বললেন, একবার ব্যবহার করে রকেট গারভেজে ফেলে দেয়ার রীতি তিনি ভাঙ্গবেন। হাতে নিলেন পূর্ণব্যবহারযোগ্য (রি ইউজেবল) রকেট প্রযুক্তি। যেই কথা সেই কাজ। বারবার ব্যবহার যোগ্য রকেট প্রস্তাব লুফে নিল নাসা। ‘স্পেস এ্যাক্স’ সত্যি সত্যি অমন রকেট বানিয়েই ছাড়ল এখন রিউজেবল রকেটের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্ব চলছে। মহাকাশ ছোঁয়ার উচ্চাভিলাসী মহাকাশ প্রকল্প। চাঁদ ও মঙ্গলে খাবার পরিবহনের জন্য পরিবহন নভোযান বানানোর ঘোষণা দিয়ে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্পেস এক্স’। মজার ব্যাপার হলো নাসা সহ পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় মহাকাশ সংস্থাগুলো পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ সরকারী টাকায়। অথচ গোটা পৃথিবীকে চমকে দিয়ে সম্পূর্ণ বানিজ্যিক ভিত্তিতে এলেন মাক্স বাস্তবায়ন করে চলেছেন একের পর এক প্রকল্প। একটি উদাহরণ দেয়াই যথেষ্ঠ। কয়েক বছর আগে তিনি নাসাকে অনেক কম দামে জ্বালানি সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি শুধু নাসার মনোপূত হয়েছে তাই’ই নয়। ইউরোপীয়, ফ্রান্স, ইসরাইল মহাকাশ সংস্থা ‘স্পেস এক্সের’ জ্বালানি কিনছে কম দামে।

মহাকাশ চর্চা মানব জাতির সর্বশেষ জ্ঞান অন্বেষণের জগৎ। এর আয়ু বড় জোর আশি বছর। এই আশি বছরে মানুষ ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মাইল উপরে শূন্যে ঘরবাড়ি অর্থাৎ মহাকাশ স্টেশন বানিয়েছে। ডজন ডজন ক্যামেরা অর্থাৎ উপগ্রহ ঘুরছে কক্ষপথে। বিল নেলসন সেদিন বলেছেন অতিশীঘ্র নাসা মহাকাশে ক্যান্সার চিকিৎসার উপর গবেষণাগার স্থাপন করতে চলেছেন। বিজ্ঞানীদের অভিমত ‘কিট্রুস’ নামের ক্যান্সারের ওষুধটি বর্তমানে শিরার মধ্যে পুশ করতে হয়। এটি তরল ডোজে রূপান্তর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবনে মহাশূন্যের ভরশূন্য পরিবেশই হল উত্তম বিকল্প। চাঁদে স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন আর মঙ্গলে মনুষ্য বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাদ’ই দিলুম। অনাগত দিন হোক বিজ্ঞানের, জয় হোক নাসার।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাফল্য
পরবর্তী নিবন্ধজেন Z এবং বাংলাদেশি ব্র্যান্ড