সিলেট থেকে চট্টগ্রামের বিভাগীয় নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সম্মেলনে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন সাংবাদিক বিলকিস সুমি আর মনিকা ইসলাম। তাঁরা সিলেট নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের একজন প্রেসিডেন্ট অন্যজন সেক্রেটারি। সারারাত ট্রেন জার্নি করে না ঘুমিয়ে এসেছেন। দুটি চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। কিন্তু অনুষ্ঠানে এসে যেন তাঁদের ক্লান্তি নিমিষে উবে যায়। এত সাংবাদিক নারীদের একই ছাদের নিচে পেয়ে তাঁরা আনন্দে আত্মহারা। আর ঢাকার সাংবাদিক নেতৃবৃন্দও কম আনন্দিত নয়। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের নাসিমুন হক আরা মিনু, আকতার জাহান, আর শেলীনা শিউলিকে পেয়ে আনন্দিত চট্টগ্রামের নারী সাংবাদিকেরা। মিনু আপা তার বক্তব্যেই বলেন তাঁর অসীম আনন্দ আর ভালো লাগার ব্যাপারটা। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক এবং নাট্যজন শিশির দত্ত, প্রেসক্লাব সভাপতি সালাউদ্দীন মো. রেজা, সেক্রেটারি দেবদুলাল ভৌমিকের উপস্থিতি ভাল লাগার মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলেছিল।
একেবারেই অনাড়ম্বর অথচ কানায়–কানায় উচ্ছ্বাস আর আনন্দে পূর্ণ এই আয়োজনটি ছিল সম্প্রতি চট্টগ্রামের বিভাগীয় নারী সাংবাদিকদের সম্মেলন উপলক্ষে নারী সাংবাদিকদের এক মিলনমেলা। এই মেলায় চট্টগ্রাম বিভাগে কর্মরত নারী সাংবাদিকরা সমবেত হন অসীম আনন্দ আর প্রত্যাশার ঝাঁপি নিয়ে। আনন্দের কারণ, প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে বসেছে নারী সাংবাদিকদের এই আসরটি। আর প্রত্যাশার কারণ হলো, কি কি নির্দেশনা তাঁরা পাবেন এই পেশায় নিজেকে টিকিয়ে রেখে একজন যোগ্য মানুষ ও দক্ষ সাংবাদিক হিসাবে গড়ে তুলতে। এই প্রত্যাশায় কিন্তু সেদিন একেবারে প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল থেকেও ছুটে এসেছিল চিং মে প্রু, এফ জে মুমু, নীলা চাকমারা। বোয়ালখালী থেকে এলো আয়েশা ফারজানা। আর নগরীর প্রিণ্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একঝাঁক নবীন–প্রবীণ সাংবাদিকের কলকাকলীতে সেদিন যেন নারী সাংবাদিকতায় এক মাইলফলক রচিত হয় চট্টগ্রামে। মনীষা আচার্য্য কি খুশি এই অনুষ্ঠানে আসতে পেরে। সে সবার আগেই এসে হাজির হয়। এরপর কিছুক্ষণের মাঝেই হলটি সাংবাদিক নারীদের আনন্দমুখর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। দীপ্ত টিভির ব্যুরো প্রধান লতিফা রুনা আনসারী তো বলেই ফেলেন, এক সময়ে আজাদী সম্পাদককে দেখলে কথা বলারও সাহস হতো না। আজ সেই প্রাজ্ঞজনকে পেয়ে বেজায় খুশি। অতিথিদের অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনামূলক বক্তব্য নারীদের আশান্বিত করে। তারা আগামীর পথ চলার একটি নির্দেশনা পান নিজেকে কীভাবে যোগ্য ও দক্ষ করে তুলবে; সেই আশার আলোই অতিথিদের বক্তব্যের মূল সুর। পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিল লতিফা আনসারী রুনা।
চট্টগ্রামে নারী সাংবাদিকদের পথচলা শুরু হয়েছিল বহু আগেই। বেগম মুশতারী শফী তাঁর ‘বান্ধবী’ মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন পাকিস্তান আমলে। সেখানে প্রেস থেকে শুরু করে প্রুফ রিডার সবাই নারী ছিলেন। পরে ৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হায়েনারা সব ধ্বংস করে দেয়। প্রেস–পাবলিকেশন সব পুড়িয়ে দেয়। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তিনি এটি কিছুকাল প্রকাশ করেছিলেন। নানা সমস্যার কারণে তা এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। দৈনিক আজাদীতে দীর্ঘদিন নারী পাতা মহিলা মাহফিল দেখতেন ফাহমিদা আমিন আপা। তিনিও পরে বয়সের কারণে তা ছেড়ে দেন। আমি ১৯৮৬ সালে প্রথম দৈনিক পূর্বকোণে একজন নারী সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকে টানা তিন যুগেরও বেশি সময় কাজ করেছি। বর্তমানে দৈনিক বাংলা ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করছি। আজাদীতে ইয়াসমিন ইউসুফ এবং শামীম আরা লুসি যোগ দেন সাব এডিটর হিসাবে ১৯৯৫–৯৬ সালের দিকে। এরপর সানজিদা মালেক দৈনিক আজাদীর আজমিশালী, নারীসহ আরও কিছু পাতায় দক্ষতার সাথে বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে আসমা বীথি নারী ও খোলা হাওয়া সহ সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করছেন। ইলেক্ট্রনিক আর অনলাইন মিডিয়ার কল্যাণে প্রচুর নারী এখন কাজ করছেন নগরীতে। তাঁদের একই ছাদের নিচে এনে সাংবাদিকতায় দক্ষ ও পেশাদার হিসাবে গড়ে তোলাই এই প্ল্যাটফরম তৈরির মূল উদ্দেশ্য। আমাদের বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের আপসহীন নেত্রী সাংবাদিক মিনু আপা অনেকদিন থেকেই বলে আসছিলেন বিভাগীয় সম্মেলন করার জন্য। আমি আর রুনা আগে থেকেই কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে যুক্ত আছি। মিনু আপার সদিচ্ছা এবং তাগিদের প্রতিফলনই আমাদের সদ্য সমাপ্ত এই সম্মেলন তা বলতে পারি বিনা দ্বিধায়। সম্মেলনে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মধ্য দিয়ে আমরা সকল সদস্যকে নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করি। যারা এই সম্মেলনে অতিথি ছিলেন তাদের শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা জানাই। আর উপস্থিত সাংবাদিক সহকর্মীদের জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আলোচনা আর মতবিনিময় এবং পারস্পরিক মতবিনিময় হয়। দুপুরে ভোজশেষে অতিথি আপাদের নিয়ে আমরা পতেঙ্গায় সদ্য নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলে যাই। টানেল দেখে সাগরতটে বিকালের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করি। সূর্য যখন সাগরে ডুব দিচ্ছিল, আকাশে তখন রং–এর ছড়াছড়ি। ছোট–বড় জাহাজ সাগরে ভাসমান। জোয়ার ছিল না বলে সাগর একেবারেই চুপচাপ। গরম–গরম পিঁয়াজু আর কাঁকড়ার দোপেঁয়াজির ঘ্রাণে আমরা যখন মতোয়ারা, তখন সিলেটের সাংবাদিক মনিকা আক্রান্ত কাঁকড়া জ্বরে। কাঁকড়ার কথা শুনে রীতিমতো শঙ্কিত। কারণ সে কখনো এটি খায়নি। এই নিয়ে চলে হাসাহাসি, মাতামাতি। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমরাও গাড়িতে উঠলাম। মেরিন ড্রাইভ ধরে সাগরপাড় ঘেঁষে যখন চলছি, সাগরের জাহাজ আর বোটগুলোতে যেন হাজার বাতির ঝিলিক। নিবিড় ঘন অরণ্যপথে এই দৃশ্য কি যে মায়াবী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাড়িতে সমানে গান চলছে। সুর আর গানের ভেলায় ভেসে ভেসে এবার গন্তব্য প্রেসক্লাব। সেক্রেটারি দেবদুলালের আমন্ত্রণে চা চক্র। প্রেসক্লাব দেখে কি উৎফুল্ল আপারা। প্রেসক্লাব থেকেই আমাদের দিনের কর্মসূচির সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটে। আবার সিলেটে দেখা হবার আমন্ত্রণ সিলেটি আপাদের। সেই দিনের অপেক্ষায় আমরা সবাইকে বিদায় দিলাম।