ওদের জিজ্ঞেস করতে মন চাইছিল, ‘জোনাকি, কি সুখে তুই ডানা দুটি মেলেছিস?’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন উপলক্ষে গত ১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শ্যামল ক্যাম্পাসে যেনো জোনাকি আর প্রজাপতির মেলা বসেছিল। কত রং–এর কত বয়সের প্রাক্তনীরা সমবেত হয়েছিল। তবে সঙ্গত কারণেই নারী শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছিল বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে, ফেলে আসা অতীতকে খুঁজে পেতে ভর করেছিল প্রজাপতির পাখনায়। উল্লাসে–উচ্ছ্বাসে তারা হাওয়ায় উড়ছিল। হলে–ক্যাম্পাসে, ডিপার্টমেন্টে, ক্যান্টিনে, ঝুপড়ি, স্টেশন, মউর দোকান, ক্যাফেটেরিয়া, শহীদ মিনার সবখানেই ছিল তাদের সরব পদচারণা। শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষাজীবনের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেয়ার স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। কলেজ অঙ্গন পেরিয়ে তারা যেদিন বিশ্বজ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে যেদিন প্রথম পা রেখেছিলেন, সেদিনের স্মৃতির কথা বললেন এমফিল ডিগ্রী অর্জনকারী মনোয়ারা আরজু। আরজু গ্রাম থেকে এসেই উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। চেয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগে পড়তে। মেরিট লিস্টে আসেন। পড়েন বাংলাসাহিত্য নিয়ে। সাহিত্য নিয়ে পড়েই তিনি তৃপ্ত ছিলেন। পড়ার জগতেই যেনো নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। এই অধ্যবসায়ের ফসল হিসেবেই তিনি ফাহমিদা আমিনকে নিয়ে এমফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করে তিনি অনেক আপ্লুত, আনন্দিত। সাংবাদিক কলিম সরোয়ারের তনয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তাসমিয়াহ তৃষা বলেন, সমাবর্তন ছিল বহুল প্রতীক্ষিত। মিশ্র অনুভূতি। করিডোরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, প্রিয় শিক্ষকদের সাথে আবার দেখা হবার আনন্দ, তাতুলনীয়। সুন্দর এবং স্মৃতিময় একটি পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সব হিসেবনিকেষ ঘুচে গেলো। প্রাক্তন হওয়া সব সময় আসলেই বেদনার। দৈনিক আজাদীর সাংবাদিক শামীম আরা লুসির কন্যা সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সিদ্দিকা নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করে বলেন, আমি সদ্য মাস্টার্স পাস করে বের হয়েই সমাবর্তনের সুযোগ পেয়েছি। এত বড় আয়োজনে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি বন্ধুদের সাথে। উৎসবের আমেজে শিক্ষাজীবনের সে এক অন্যরকম প্রাপ্তি। পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই যেনো উচ্ছ্বাস আর আনন্দের বন্যা ছিল। যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাংবাদিক মারজান আকতার বলেন, প্রচণ্ড গরম আর প্রখর রোদের তেজ উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন যে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটেছে, তাই বলে দেয় এই সমাবর্তন কতটা উৎসবমুখর হয়েছে। এটি ছিল মূলত: স্মৃতিচারণ ও স্মৃতিধারণের উৎসব। কালো টুপি, কালো গাউন কেউ মা বাবাকে পরিয়ে দিয়েই সীমাহীন আনন্দের জোয়ারে ভেসেছে। আর বন্ধুরা কেউ কেউ হয়তো বা পাঁচ, সাত, আট, দশ বছর পরেও বন্ধুদের পেয়ে ২৩০০ একরের বিশাল এই ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়ানো পুরনো স্মৃতিকেই লুফে নিয়েছে। বিশিষ্ট কবি ডা. ডালিয়া এন নাহার পুত্র রাহী এবং পুত্রবধূ প্রমা (দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) সমাবর্তনে গিয়ে আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত। ডালিয়ার স্বামী মাইনুল হাসানও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি সদ্য অবসরে এসেছেন। একজন শিক্ষক প্রাক্তন শিক্ষকের স্ত্রী, সমাবর্তী পুত্রের মা এবং পুত্রবধূর শাশুড়ি হিসেবে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, পাহাড় আর সমতলবেষ্টিত প্রাকৃতিক সুষমায় ভরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জারুল, সোনালু আর নানা ফুলে সুশোভিত। প্রচণ্ড তাপদাহের মাঝেও সমাবর্তনকে সার্থক করে আনন্দ ভাগাভাগি করতে দূর দুরান্ত থেকে ছুটে এসেছে প্রাক্তনীরা। এসেছেন গর্বিত অভিভাবকেরা। আমি আর আমার স্বামী পুত্র আর পুত্রবধূকে উৎসাহ দিতে এসেছি। উৎসবমুখর ক্যাম্পাস দেখে অভিভূত হয়েছি। বান্দরবান থেকে কন্যার সাথে এসেছিলেন বেতারের সংবাদ পাঠিকা শিরীন খানম। একজন অভিভাবক হিসেবে তাঁর অনুভুতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে তাদের মা বাবা, স্ত্রী, স্বামী, সন্তান সন্ততি–কি বিশাল সমাগম। আর এই অনন্য সমাগমে আমার মেয়েও আছে! এই অনুভূতি আমার কাছে এক বিরল ঘটনা। তার চোখে মুখে সেদিন যে আনন্দ আর হাসির ঝিলিক দেখেছি, তা ছিল সবার চোখেমুখে। এতবড় আয়োজন সমাবর্তনের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তীব্র গরমেও সমাবর্তীরা তো বটেই, সেদিনের উপস্থিত সকলেই ভেসেছিল আনন্দ আর উৎসবের জোয়ারে।