“নারীরা ঘরে সময় দিলে তাদের সম্মানিত করবে সরকার”!
উপরের বক্তব্যটি একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। সার্বিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে রাজদণ্ড তাদের থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
গত ১৫ মাসে যে পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসে তাতে উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা যা আমাদের অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বড় রকমের ধাক্কা। ইউ এন ওম্যানের ২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত জেন্ডার ভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত অর্থ বছরের প্রথমার্ধে প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী। যা মোট চাকরি হারানো মানুষের ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে মাত্র ১৯ শতাংশ নারী কর্মজীবী শ্রম বাজারে সক্রিয় যা কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একসময় পোশাক শিল্প কারখানায় ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল নারী শ্রমিক। বর্তমানে তা উদ্বেগজনকভাবে কমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস শ্রম শক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালে কর্মজীবী নারী ছিল তিন কোটি ছাপ্পান্ন লাখ থেকে তিন কোটি, আশি লাখ, দশ হাজারের বেশি। অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৬ লাখ, ত্রিশ হাজারের মতো। ২০২৫ শে এসে সেই সংখ্যা আরও কমেছে। ইউ এস এ আইডির থ্রাইভ ইন বাংলাদেশ প্রকল্পে আয়োজিত তৈরি পোশাক খাতে নারীদের টেকসই ভবিষ্যৎ শীর্ষক আলোচনা সভায় জানানো হয়, তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের হার ৫৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিরতা, কম মজুরি, দীর্ঘ কর্ম ঘন্টা, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাপ, স্বয়ংক্রিয় মেশিন চালানোর দক্ষতার অভাব, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না–থাকা, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নিপীড়ন, সন্তান লালন পালন, গৃহস্থালি কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে এ খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে এসেছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নারীর সামাজিক মর্যাদা ও পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল রাখতে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণেও নারীরা শ্রমশক্তি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করছেন দেশের নারীপুরুষ নির্বিশেষে বেকারত্ব কমাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
নারী অধিকার কর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৫/১৬ মাস পূর্ণ হলেও নারী সমাজের প্রত্যাশা পূরণে কোন কাজ হয়নি। নারী বিষয়ক কমিশন গঠন হলেও তার প্রতিবেদন একটা রাজনৈতিক দলের সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে পড়ে। তারা নারী সংস্কার কমিশন প্রধানের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে ও নানা গালাগাল দিয়ে মিছিল মিটিংয়ের আয়োজন করে। এই কারণে সম্ভবত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়নি সরকার। নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, আমরা মনে করেছি, নারীর প্রতি সকল বৈষম্যের বিলুপ্তি ঘটবে এবং নারীর জন্য সহিংসতামুক্ত জীবন হবে। কিন্তু নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। তিনি দুঃখ করে বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল না। এই বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েও কোন উত্তর পাইনি।
এই সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক কোটা বাতিল করেছে! প্রজ্ঞাপন জারি করে আবার স্থগিত করেছে প্রাইমারি স্কুলে শরীর চর্চা ও সংগীত বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগের! এটা অবশ্যই আমাদের হতাশ ও উদ্বীগ্ন করেছে। এই সরকার তো কোন রাজনৈতিক চাপে থাকার কথা নয়! অজুহাত হিসেবে জানিয়েছে অর্থসংকট। এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসার কারণ হয়তো তারাই যারা নারীদের ঘরে থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন।
জুলাই সনদে নারীর কোন অধিকারের কথা লেখা আছে কিনা জানিনা। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোন ধারা যুক্ত হয়েছে কিনা জানি না। নারীর অধিকার নিয়ে আদৌ একটা লাইনও যুক্ত হয়েছে কিনা তাও জানি না! নারী সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশগুলো হয়তো হারিয়ে যাবে, হয়তো উইপোকা’র খাদ্য হবে ফাইলগুলো একদিন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নারীর জন্য আরও কঠিন হবে জীবন। আরও নানা সংকট এসে সামনে দাঁড়িয়ে যাবে! নারী, তুমি এটা করতে পারবে না, নারী, তুমি ঐটা করতে পারবে না!
আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন বিশ্বনন্দিত মানুষ। অত্যন্ত আধুনিক উদার মানুষ। সেই কারণে আমাদের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। কোনভাবেই আমরা এই সরকারের কাছে রাজনৈতিক সরকারের মতো আচরণ প্রত্যাশা করিনি। এই সরকার অনেক শুভ কাজের সূচনা শুরু করতে পারতেন। তার বদলে নানা ভুল সিদ্ধান্ত সাধারণ জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে। দেশের মূল জনসংখ্যার অর্ধেক নারী তাকে পিছনে রেখে দেশ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না। নারীরা যত ভালো কর্মপরিবেশ পাবে, যত ক্ষমতায়িত হবে ততই এগিয়ে যাবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র। এই পিছিয়ে যাওয়া সময়ে বেশি বেশি কর্মক্ষেত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি না করে, একবিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা কেন নারীকে গৃহবন্দী করার কথা ভাববো! জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যমূলক সমাজ কখনও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে না। যে নারী বাইরে কাজ করে, অর্থ উপার্জন করে সেই তার সংসারটাকেও যত্নে রাখে। সে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনকে গেঁথে নিতে শিখে। বাইরের পরিবেশ তাকে সচেতন ও আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগ তৈরি করে দেয়। একজন আত্মবিশ্বাসী নারীর চেহারায় যে দীপ্তিময়তা ছড়িয়ে যায় তার তুলনা আর কিছুই হতে পারে না। শুধুই একটাই চাওয়া নারী বান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠুক, কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি হোক নারী–পুরুষ উভয়ের জন্য। নারী–পুরুষের যূথবদ্ধ লড়াইয়ে আমাদের দেশটা এগিয়ে যাক।











