সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গত ২৫ নভেম্বর পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। বিভিন্ন নারী আন্দোলনকারী সংগঠন ১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদা এবং গুরুত্ব সহকারে পালন করা শুরু করে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে জাতিসংঘ ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক ব্যাধি। নারীর প্রতি পুরুষের অধঃস্তন ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। এ অবস্থায় নারীর সমঅধিকার নিশ্চিতে ছাত্রসমাজকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।’ রাজধানীতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত সাম্প্রতিক শোভাযাত্রায় কথাগুলোর প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। ‘পারিবারিক আইনে সমতা আনি, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করি’ স্লোগানের আলোকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, সহিংসতার ঘটনা কেবল নারীর জীবনকেই বিপন্ন করে না; বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অগ্রগতিতে বাধা দেয়। তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জেন্ডার সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা, শারীরিক–মানসিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, বহুবিবাহ, যৌন হয়রানি, খুন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘নারীর প্রতি অধস্তন ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, নারীবান্ধব আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করতে না পারা, বিচারিক কাজে দীর্ঘসূত্রতার ফলে নারীর উন্নয়ন, তথা দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা নির্মূলে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব– এসব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন ও যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিতে ছাত্রসমাজের ভূমিকাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।’
নারীর প্রতি পুরুষের যে মনোভাব তা এখনো অনেক নিচে পড়ে আছে। নারী নির্যাতন এখনো অনেকের চোখে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নারীকে আরও বেশি পণ্যে পরিণত করেছে। আসলে নারীকে পুরুষের সমমর্যাদা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের মানসিক বৈকল্য দূর করা। এটা সবচেয়ে জরুরি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার এক ধরনের অদম্য মনোভাব। এজন্য নারীদের দীর্ঘ লড়াই করতে হবে।
অস্বীকার করা যাবে না, দিন দিন নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে চলেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা আপসযোগ্য নয়। কিন্তু আপস হচ্ছে। যেকোনো কারণেই স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই মামলা করতে হবে, একথা ঠিক না। মামলার বাইরে সামাজিক ও পারিবারিক সহায়তায় কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটা বিষয় দেখা যায়, বাদী–বিবাদী প্রায় সময়ই অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে মামলাকে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। ঘটনা যা সেটা দিয়েই মামলা দায়ের করা উচিত। মামলার ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একটা মেয়ে কখন মামলা করতে আসে, যখন তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তাই যেকোনোভাবেই হোক না কেন আইনি সহায়তা প্রদান করতে চেষ্টা করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগী নারীকে কিছুটা সহায়তা করা যায়। সংসারে নারীর অবদানকে মূল্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনে অর্জিত সম্পত্তিতে নারীর অধিকার দিতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নারীবান্ধব। নারীদের সুরক্ষার জন্য প্রণীত আইন ও নীতি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব হওয়ার কথা নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের অনেক ভালো আইন আছে। এখন আইনগুলোর প্রয়োগের জায়গায় জোর দেওয়াটা জরুরি। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে না ভেবে সামনে এগোনো যাবে না। নারী–পুরুষ সবাই সমান। তা বিবেচনা করে আগামী দিনে কীভাবে নারীদের নির্যাতন বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন দরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা হচ্ছে, আইনসমূহ কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে তদারক করা প্রয়োজন।