আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছর এই দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়। জাতিসংঘ কিন্তু দিবসটির আয়োজক। তবে এই দিবসের সূচনাকারী জার্মান নেত্রী ক্লারা জেটকিন। তিনিই সর্বপ্রথম ৮ মার্চকে নারীদিবস হিসেবে স্বীকৃতি দান করে তা পালন করার আহবান জানান। জেটকিন এর এই আহ্বানের রয়েছে এক করুণ প্রেক্ষাপট। নিউইয়র্কের সূতা কারখানায় মজুরি বৈষম্যের প্রতিবাদে ৮ মার্চ নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকালে রাজপথে গুলি চালালে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় নারীসমাজ প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সোচ্চার হয়ে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপের আহ্বান জানান। অবশেষে জাতিসংঘ দিবসটি স্বীকৃতি দিয়ে প্রতি বছরে নিত্য নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ নারী দশক, বেইজিং প্লাস, সিডও সনদ সবকিছু কিন্তু নারীর অগ্রগতি আর উন্নয়নের জন্যই জাতিসংঘ করেছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও দিবসটি পালিত হয়। জাতীয় প্রতিপাদ্য এবং আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিপাদ্যই থাকে। সেই ধরাবাহিকতায় এবারের প্রতিপাদ্য হলো– “অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন।”
অধিকার,ক্ষমতায়ন মানেই তো নারী আর কন্যার উন্নয়ন। দিবসটি পালিত হচ্ছে কিন্তু অনেক দিন আগে থেকেই। এর ইতিবাচক দিক হলো আমাদের নারী সমাজ অনেক সচেতন হয়েছে। নারীরা শিক্ষিত হয়েছে, সমাজের কুসংস্কার আর চার দেয়ালের কঠিন নিগড় ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে। নিজেদের অধিকার মর্যাদা আর সম্মান কি তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এই আধিকার আর প্রাপ্য সম্মান আমাদের কয়জন নারী নিতে পারছেন? এখনো নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এখনো নারী যে কোনো সংকটে বা বিপদে–আপদে চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। শিকার হচ্ছে মানসিক পীড়নের। এখনো চলন্ত বাসে নারী শিকার হচ্ছে পুরুষের লালসার। কেবল শারীরিক নির্যাতন না, হত্যা ও খুনের ঘটনাও ঘটছে।
এবারের নারী দিবস প্রসঙ্গে নগরীর প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল লিটল জুয়েলস এর প্রিন্সিপ্যাল এবং জোন্টা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অফ উইমেন–এর বোর্ড মেম্বার দিলরুবা আহমেদ বলেন, আমি শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি। কন্যা শিশুদেরকে নারী পুরুষ বৈষম্য থেকে মুক্ত করে তাদেরকে মানুষ হিসেবেই গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি দীর্ঘকাল ধরেই। আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আমরা প্রতি বছরই দিবসটি পালন করি। নিজেদের অধিকার আর মর্যাদাকে সমুন্নত আর শক্তিশালী করতে আমাদেরকে শিক্ষা, মানবিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতায় অভিজ্ঞ ও দক্ষতা অর্জনে এগিয়ে আসতে হবে। একজন নারী যখন নিজেকে শক্তিশালী করে প্রবহমান নদীর মতো চলে, তখন কেউই তার অর্জনকে থামিয়ে দিতে পারবে না। আমাদেরকে কন্যা শিশুদের কল্যাণে বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের প্রতিষ্ঠিত করার পথ করে দিতে হবে।
পুনাক সভাপতি সামিরা আজিজ বলেন, নারী দিবস প্রতি বছর আমাদেরকে নিজেদের অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা আমাদের সঠিক অবস্থানই জানি না এই দিবস আমাদেরকে অধিকার, সচেতনতা, মর্যাদা এবং গুরুত্ব অনুধাবনের সুযোগ করে দেয়। প্রথমত, নারীর প্রথম দায়িত্ব সংসার তথা পরিবার। পরিবারকে সুন্দর, নিরাপদ এবং সুসংগঠিত করতেই নারীর ভূমিকা অসামান্য। দ্বিতীয়ত, ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখেছি সেসময়ে নারীরা আমাদের নবীজি (রা.) ও সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। বিখ্যাত যোদ্ধা ও সাহাবী নুসাইব বিনতে কাব উহুদ যুদ্ধ ও হুদাইবিয়ার যুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সনাতন ধর্মেও দুর্গা দেবীকে মা বলে থাকেন। একইভাবে খ্রিস্টান ধর্মেও মরিয়মকে মাতা মেরী বলা হয়। কাজেই নারী অনেক সম্মানিত। বিধাতা সম্মান এবং শক্তিমত্তা দিয়ে অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেই নারীকে সৃষ্টি করেছেন। তবে নারী পুরুষের প্রতিযোগী নয়, সহযোগী এটিই মনে রাখতে হবে। সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে, ঘরে আর বাইরে গিয়েও যেনো সে কাজ করতে পারে। মেধা, প্রজ্ঞা আর মার্জিত রুচি নিয়ে পরিবারের পছন্দের মানুষের পাশে গিয়ে যেনো দাঁড়াতে পারে নারী, সেটিই লালন করতে হবে। তৃতীয়ত, আমরা দেখেছি দেশের যে কোনো সংকটে নারী রাজপথে নেমেছে। ৫২,৭১ ছাড়া গণ আন্দোলনে নারী ছিল মিটিং মিছিলে। সাম্প্রতিক ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও আমরা দেখেছি কন্যাদের পাশাপাশি মায়েরাও রাজপথে নেমেছিলেন। কাজেই নারীর দায়িত্বের যে বিশালতা সেদিকটাকে স্বীকার করেই আমরা যেনো আমাদের ঘরের ছোট্ট কন্যাটাকে খাটো করে না দেখি, তার কথাকে যেনো গুরুত্ব দিই, পুত্রবধূকেও স্পেস দিই, যাতে সে ভাবতে না পারে সে অন্য এক পরিবারে এসেছে।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. বাসনা মুহুরী বলেন, নারীর সম্মান আর মর্যাদার পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নারী আজ অনেক দূর এগিয়েছে মেধা আর প্রজ্ঞায়, ফলে, একসাথে সংসার এবং প্রফেশন দুটো সামাল দিতে গিয়ে নারী রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে। কিন্তু তার নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কেউ ভাবে না। নারীর পথ চলার নিরাপদ পরিবেশ দিতে হবে। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ এসবের অবসান হোক। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি এসব ঠিকানা থেকে মুক্ত হয়ে কবে নারী তার নিজস্ব ঠিকানা খুঁজে পাবে, সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
নারীদের ভাবনা আর চিন্তাচেতনার সাথেই সুর মিলিয়ে বলতে চাই,আমরা নারী তাই আমরাই সব পারি। আসুন শ্রেণিভেদ ভুলে গিয়ে আমরা নারীর অধিকার, মর্যাদা আর সম্মান–এর পথ সুগম করি। নারী পুরুষ বিভেদ সৃষ্টি না করে, একে অপরকে প্রতিযোগী না ভেবেই সমাজ বিনির্মাণে কাজ করি। তবেই নারী দিবস উদযাপন সফল হবে। বিশ্বের ও দেশের সকল নারীকে জানাই শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।