স্কুল পড়ুয়া মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী অধ্যাপক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একটি বাড়তি দায়িত্বেও ছিলেন। মেয়ের শ্লীলতাহানি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ও হাইকোর্টে রীট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং উপাচার্য তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনবিরোধী কাজ করেছেন বলে অভিযোগ করেন এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গেরও অভিযোগ তোলা হয়।
এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক মায়ের গল্প, তাহলে বুঝতেই হয় আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির ধ্যান ধারণায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কতটা প্রবল। কিভাবে আশা করা যায় সমাজের বিভিন্নস্তরে ঘটে যাওয়া এই যৌন সন্ত্রাসের যথার্থ বিচার? তাছাড়া এই বিচার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে কয়জন? নিয়ত নারীর মন ও মগজে চাষাবাদ চলে চুপ থাকার মন্ত্র। এই চুপ থাকতে থাকতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। এসব ক্ষেত্রে সব সময় ভিকটিমকেই অপরাধী করে তোলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। ধর্ষণের অপরাধ আদালতে প্রমাণ করার ক্ষেত্রেও আইনের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী বাধা হিসেবে কাজ করে। ধর্ষণের শিকার নারীর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ ও প্রকাশ করার অতি আপত্তিকর প্রবণতা আইনের যথাযথ প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটায়। ধর্ষণ ও ধর্ষণের পরে খুন ছাড়াও নানা ধরনের সহিংসতা চলছে নারীদের উপর। ৮৭ শতাংশ নারী নিজের ঘরেই নিগৃহীত হচ্ছে। ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
তাছাড়া পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনে অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। নারী উন্নয়নের নীতি ঘোষিত হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মুখে বড় বড় বুলি আওড়ালে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা আমাদের তিন লক্ষ মা বোনকে নির্যাতন করেছিল। এই নির্যাতিত মা-বোনদের অনেক পরিবার গ্রহণ করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে। নিজের ঘরে তাদের ঠাঁই হয়নি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ আর কি হতে পারে? পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমাদের সরে আসতেই হবে। ধর্ষিত হওয়া ধর্ষিতার অপরাধ নয় ধর্ষকের অপরাধ। নারী মুখ খুলুক। অপরাধী চিহ্নিত হোক। একটা অন্যায় পুষে রাখা মানে আরও একটা অন্যায়ের সুযোগ করে দেওয়া।
যতদিন নারী মুখ খুলবে না ততদিন ধর্ষনকামী পুরুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। নারীর নিজ শক্তিকে তার অনুভব করতে হবে, নিজেকে দুর্বল ভাবা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপরাধের শিকার হওয়ার পরও যখন সমাজ তার উপরই দোষ চাপিয়ে দেয় তখন বুঝতে হবে এ সমাজ, এ রাষ্ট্র তোমার নয় নারী! এটা পুরুষের, কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করলেই এই জঘণ্য অপরাধ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কেবল শাস্তি নয় বরং সংশ্লিষ্ট আইনের যে অন্যান্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা নিরসন করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষা কারিকুলামে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু সমন্বিত পদক্ষেপ ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
শাস্তি প্রদানের বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা ও সুস্পষ্টতাই কেবল অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে।