গবেষণা ও শেখার শেষ নেই। বাঙালি নারীর এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস ঈর্ষণীয় হলেও তারা এখনো উহ্য। নারীদের এখনো বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে সমাজে স্বীয় স্থানে পৌঁছাতে হয়। আনোয়ারা আলম তেয়াত্তর বসন্ত পেরিয়ে এসেছে, এখনো সমানতালে লিখে চলেছেন। গবেষণায় তিনি অদম্য। জীবনে ঘাত–প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু সেগুলোকে তিনি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষ প্রতিনিয়ত শেখে এবং শেখায়। প্রত্যেক মানুষের বেলায় এহেন কথা প্রযোজ্য নয়। সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা প্রতিনিয়ত শেখান, শেখেনও। স্তরায়িত সমাজে এক্ষেত্রে কোনো নারী যদি প্রভাব বিস্তার করেন কিংবা ভূমিকা রাখেন, মানুষকে আলোকিত করেন, আন্দোলিত করেন সেটা দৃষ্টান্ত। পুরুষশাসিত সমাজে সবাই তা পেরে উঠেন না। যতোই আমরা বুলি আওড়ানি কেন নারীর পথচলা মসৃণ নয়। তাদের এখনো গৃহকর্মী হিসেবে ভাবা হয়। কিন্তু আনোয়ারা আলম এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি প্রতিনিয়ত সম্মুখপানে এগিয়ে চলেন। স্বীয় গুণে গুণান্বিত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজসেবা, গবেষণা, উপস্থাপনা প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি উজ্জ্বল। মেধা ও ধৈর্য্যের জন্য তাঁর রয়েছে পরিচিতি।
সমাজে সব মানুষ উচ্চ মেধাসম্পন্ন নয়। উচ্চ মেধা ও মননের অধিকারীরা সমাজে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যার দরুণ সমাজে ইতিবাচক ধারা সূচিত হয়। আনোয়ারা আলম সাহিত্যের মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখেননি। নারী ক্ষমতায়ন, অধিকার, সমাজভিত্তিক সমাজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার। তাঁর পদচারণা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা–প্রশাখায়। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি শিশুদের জন্য তাঁর লেখনি শক্ত ভিতর উপর নির্মিত। তাঁর লেখনিতে নানা স্বাদ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ‘চট্টগ্রামের নারী’ ও ‘শিশির থেকে শবনম’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্যাপক খ্যাতি। এছাড়াও ‘বসন্ত বৃষ্টি’, ‘নারী ও সমাজ’, ‘অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী,’ ‘ভিন দেশে ঝরা পালক’ ‘আমার শিক্ষকতার জীবন’, ‘ছোটদের প্রীতিলতা’, ‘ছোট্ট এক রাজকুমারী’, ‘নারীর জীবন এবং ইত্যাদি’, ‘প্রসঙ্গ প্রিয়–অপ্রিয়’, ‘গোধূলি বেলায় মেঘের বেলায়’, ‘এক যে ছিল রাজকুমারী’, ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম’, ‘গেরিলা যোদ্ধার গল্প শোনো’, ‘যাদুর শহর’ প্রভৃতি। ‘নারী ও শিশু পাচার’ ‘পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ তাঁর গবেষণা কর্ম।
‘নারী ও শিশু পাচার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি আনোয়ারা আলমের এমফিল গবেষণা কর্ম। গ্রন্থ আকার প্রকাশের জন্য নতুন তথ্য–উপাত্ত দিয়েছেন। গ্রন্থটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছে শৈলী প্রকাশন। শেরওয়ানী ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে গ্রন্থের মুদ্রণ তত্ত্বাবধানে আইকো। প্রচ্ছদ আঁকিয়ে মোমিন উদ্দিন খালেদ। দাম রাখা হয়েছে ৬শ টাকা। সুন্দর, ঝকঝকে অফসেট পেপারে প্রকাশিত বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ই লার্নিং, বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল হুদা খানকে। তিনি গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন ‘সভ্যতার শুরু থেকে মানব পাচার যুগে যুগে ছিল, কিন্তু এখন এর আকার, ধরন ও কৌশলের নানারূপে আমরা দেখছি যা দুঃখজনক। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিও এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।’
‘নারী ও শিশু পাচার’ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি পাঁচ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায় : নারী ও শিশু পাচার সমস্যার প্রকৃতি, পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য সভ্যতার বিস্তার নারী ও শিশুর অবস্থান এবং কবিতাবৃত্তি, দ্বিতীয় অধ্যায় : পাচারের সংজ্ঞা ও এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের পাচারচিত্র, তৃতীয় অধ্যায় : পাচার সংক্রান্ত অবস্থান জানার উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, চতুর্থ অধ্যায় : নারী ও শিশু পাচারের কারণ কৌশল, পদ্ধতি ও প্রভাব, পঞ্চম অধ্যায় : নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন, শিশু পাচার রোধে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা, সার্ক সংক্রান্ত সার্ক কনভেনশন, পাচার রোধে সার্কের আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রম, পাচার প্রতিরোধে করণীয়–প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন। প্রতিটি অধ্যায় আবার বিভিন্ন উপ অধ্যায়ে বিভক্ত। টেনেছেন আবার উপসংহারও।
আনোয়ারা আলম নারী ও শিশু পাচারকে ক্যান্সারের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু এর ব্যাপকতা ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ। কেমো কিংবা রেডিওথেরাপি দিলেও এর কার্যকারিতা পাচারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সুফল বয়ে আনবে না। ট্রাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। ঐ বছরের সূচকে বাংলাদেশ টায়ার মাইনাস টু থেকে টায়ার টুতে উন্নীত হয়েছিল। গত এক দশকে ৫০ হাজার নারী, ভারত কিংবা ভারত হয়ে অন্য দেশে পাচার হয়েছে। তবে এখন আর পাচার শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমে হচ্ছে তা নয়, পাচারের ক্ষেতে অপেক্ষাকৃত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ উপায় ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। পাচারের জন্য যত খুশি বিয়ে। যশোরের মনিরের কথা অনেকেই জানেন। বাংলাদেশি এই যুবককে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে পাচারের উদ্দেশ্যে ৭৫ টি বিয়ে করে। এই ধরনের মনিরের সংখ্যা এখন আরো বেশি। শুধু বাঙালি নারী নয়, ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর নারী ও শিশুরাও পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছেন। এছাড়া টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন, চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার হচ্ছে নারী। পাচার বেশি হচ্ছে ভারতে। নানা প্রলোভনে পাচার হয়ে শেষতক যৌনপল্লির বাসিন্দা হয়ে উঠে তারা। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিরি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।
২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মানব পাচার অপরাধের বিচারের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই আইনের অধীনে অপরাধগুলো আমলঅযোগ্য, আপসের অযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। আইনের ৬ ধারায় মানবপাচার নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড কিংবা কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ৭ ধারায় আছে, সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। ধারা ৮ এ অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দণ্ড হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ১১ ধারায় পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দণ্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৫–এর ৫ ধারা নারী পাচারকে অপরাধের স্বীকৃতি দিয়ে এর বিচারের জন্য তিনটি ধারা রাখা হয়েছে। প্রথমটি হলো-‘যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনী ও নীতিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে বিদেশ হতে আনয়ন করেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় ও বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক বিশ বছর কিন্তু অন্যূন দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
‘নারী ও শিশু পাচার পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লেখক সুস্পষ্টভাবে পাচারের জন্য দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক্য বৈষম্য, আইন–শৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষাকারীর অদক্ষতা, উদাসীনতা, কর্তব্যে অবহেলা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াকে দায়ী করেছেন। সাথে রোহিঙ্গা আমাদের জন্য বোঝা এবং পাচার ও নানা অপরাধের যুক্ত সেটিও সুনিপুণভাবে গ্রন্থিবদ্ধ করেছেন। ‘রোহিঙ্গা দালালরাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া মানব পাচারের এ (টেকনাফ) রুটটি আবিষ্কার করে। অস্বচ্ছল ও বেকার যুবকদের জীবন বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নগদ ১০ থেকে ২০ হাজার ও দেড়–দুই লাখ টাকা বাকিতে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার শর্তে ফাঁদে ফেলছে, বিশেষ করে যুবকদের। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ছোট নৌকাযোগে উপকূল থেকে সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দেয়া হয়। সেই ট্রলারে ১০ দিন পর থাইল্যান্ড পৌঁছে দেয়। [নারী ও শিশু পাচার পরিস্থিতি’ পৃষ্ঠা–১৪৬] ।
গবেষক আনোয়ারা আলম গ্রন্থটিতে পাচার রুট ও সমস্যাই শুধু চিহ্নিত করেননি, যুক্ত করেছেন গবেষণার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য। করণীয় ও সুপারিশ যুক্ত করেছেন, দিয়েছেন স্বীয় মতামত, তথ্যপঞ্জি–যা তাঁর গবেষণাকর্মটিকে আন্তর্জাতিকতা এনে দিয়েছে। তিনি অর্থনীতিবিদ হওয়ায় নারী ও শিশু পাচারের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। আবার এমফিল ও পিএইচডির সুপারভাইজার সমাজবিজ্ঞানী ড. ওবাদুল করিম হওয়ায় সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মিশেল ঘটিয়েছেন ভালোভাবেই। নারী ও শিশু পাচার এক ধরনের সংিহসতা, যা মানব সভ্যতার প্রতি উপহাস। তবে এটাও ঠিক, নারী ও শিশু পাচারের সব কারণ তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এরপরও বলতে হয়, গবেষণাকর্মটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। গবেষণাগ্রন্থটি সহজ ও সরল বাক্যে লিখিত হওয়ায় সুখপাঠ্য। পাঠক মহলেও হয়েছে সমাদৃত।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক