গাজা–লেবাননসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃদ্ধ–নারী–শিশু হত্যা ও এদের প্রতি সহিংসতা–বর্বরতার ভয়াবহতা বিবেকবান বিশ্ববাসীকে হতবাক করছে। এতে করুণ আর্তনাদে সভ্য মানবগোষ্ঠীর হৃদয়ে সীমাহীন রক্তক্ষরণে গভীর ক্ষত তৈরি হচ্ছে। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও গণহত্যার জন্য দায়ী ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কর্তৃত্ববাদ–আধিপত্যবাদের মোড়কে জঘন্য হত্যাযজ্ঞের দৃশ্যাদৃশ্য প্রতিনিয়ত বেপরোয়ারূপ পরিগ্রহ করছে। সম্প্রতি দেশে ছাত্র–জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরচারী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তিন মাসের অধিককাল পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিপুল সংখ্যক ছাত্র–জনতার প্রাণ বিসর্জন ও অগণিত আহতদের আহাজারিতে দেশবাসী এখনও শোকে মুহ্যমান। গণহত্যার দায় চিহ্নিত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিতকল্পে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশ্বখ্যাত উচুমার্গের মানবতাবাদী সাহিত্যিক লিও টলস্টয় এর অমিয় একটি বাণী প্রাসঙ্গিকতায় উপস্থাপন করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তুমি নিজের কষ্ট অনুভব করো, তবে তুমি জীবিত। কিন্তু যদি তুমি অন্যের কষ্ট অনুভব করো, তবে তুমি প্রকৃত মানুষ।’ মূলতঃ মনুষ্যত্বের পরিচয় বহনকারী যেকোন ব্যক্তির কাছে পীড়াদায়ক এসব অপরাধের বিচার প্রত্যাশিত। অবশ্যই আইনের শাসনের গতিধারার সাবলীল প্রবাহমানতায় উল্লেখ্য বিচার ব্যবস্থা সর্বত্রই সমাদৃত হবে।
বেশকিছুকাল ধরে বাংলাদেশে অপরাধ কর্মের চিত্রপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। মানুষরূপী দানবদের হিংস্র অভিপ্রায়ে পরিচালিত অপরাধ সমূহের ব্যাপকতা যেকোন সুস্থ মানুষের বিবেককে তাড়িত করবেই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সংস্কার অধিকমাত্রায় প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিমধ্যেই অধিকাংশ অপরাধের চিত্র প্রকাশিত না হলেও গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদসমূহে এসবের দৃশ্যমানতা জনজীবনকে ব্যাপক আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে নানামুখী অপরাধ ঘটানোর পিছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্তও নেহায়েত কম নয়। জনশ্রুতিমতে, দেশে অরাজকতা–অস্থিরতা তৈরিতে এসব ঘটনার আড়ালে গভীর ষড়যন্ত্র বিদ্যমান। অপরাধীদের বিভিন্ন অপতৎপরতা অপরিমেয় পর্যায়ে পর্যবসিত। অচিরেই কঠিন–কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, মাত্রিকতা–ধরন–নিষ্ঠুরতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নৈমিত্তিক জীবন যাপনে ঘটনাসমূহের প্রভাবে সমগ্র নাগরিকবৃন্দের স্বাভাবিক বোধগম্যতা চরমভাবে আক্রান্ত। সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন সমগ্র বিশ্বজুড়েই শিশুরা যৌন হয়রানি–সহিংস আক্রমণ–শারীরিক শাস্তি–মানসিক নির্যাতন ও অবহেলাসহ নানা ধরনের নির্মমতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশেও শিশুরা অনেকাংশে প্রতিনিয়ত এমন কদর্য পরিস্থিতির সম্মুখীন। সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে নারী ও নিষ্পাপ শিশুদের প্রতি পৈশাচিকতার ঘটনা বৃদ্ধির প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের এ সময় পর্যন্ত আলোচিত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে নারী ও শিশু প্রতি সহিংসতার মাত্রা সহজেই অনুধাবন করা যাবে। ১৭ অক্টোবর ২০২৪ কুমিল্লা সদরের জাঙ্গালিয়া এলাকায় ৯ বছরের এক মেয়েকে গৃহকত্রী কর্তৃক নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের পর তাকে বাথরুমে আটকে রেখে বাসার দরজায় তালা দিয়ে বন্দি অবস্থায় রেখে চলে যায় বাসার লোকজন। তার চোখে–মুখে ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অমানবিক নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সিলেটের কানাইঘাটের ৫ বছরের ফুটফুটে শিশু মুনতাহা চলতি মাসের ৩ তারিখ নিখোঁজ হওয়ার পর ১০ নভেম্বর তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের দাবি, তাকে হত্যা করে গলায় দড়ি বেঁধে বাড়ির পাশে পুকুরে ফেলে দিয়েছিল তারই প্রতিবেশী এক মহিলা। ১২ নভেম্বর ঢাকার সাভারে মাথা ও কনুই থেকে দুই হাত কাটা অবস্থায় এক মহিলার মরদেহ পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলের অদূরেই পলিথিন মোড়ানো অবস্থায় পড়েছিল কাটা মাথা ও দুই হাত।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫৪ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৭ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছর এবং ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২৬৭ জন। তাছাড়া একই সময়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে আরও ৫২১টি শিশু। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের তথ্য আরও ভয়াবহ। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১ শতাংশ। নারী ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শিশু ধর্ষণের মোট ঘটনার প্রায় ৭৪ শতাংশ ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে। এক বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের নারীও হচ্ছে ধর্ষিত। এগুলো প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যা। এর বাইরে রয়েছে আরও অসংখ্য। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা কম উঠে আসছে গণমাধ্যমে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন– ২০০০ এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলার অর্ধেকই ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে করা হয়েছে। এ সংখ্যা ৬ হাজার ২০২। এসব মামলার মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ হাজার ৩৩২টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১ হাজার ৮৭০টি মামলা হয়। আরও আছে যৌতুকের কারণে নির্যাতন মামলা ৩ হাজার ২০৮টি, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের মামলা ৪৭, অপহরণের ঘটনায় ৩ হাজার ২৮৭ এবং শিশু পণবন্দী করে রাখার অভিযোগে ২৫টি মামলা। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে যৌতুকের কারণে ১৩৬ নারী এবং ধর্ষণের পর ১২ নারী ও ১১ শিশুকে হত্যা করা হয়।
অক্টোবর মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২০টি দেশের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে প্রণীত গবেষণা মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতি ৮ জনে ১ জন জীবিত কত্যাশিশু ও নারী ১৮ বছর বয়সের আগে ধর্ষণ অথবা অন্য যেকোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা প্রায় ৩৭ কোটি। যৌন সহিংসতার বিষয়টি ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সীমানা পেরিয়ে গেছে। যদি মৌখিক ও অনলাইন নিপীড়নের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বর্তমানে ৬৫ কোটি বা প্রতি পাঁচ জনে একজন। এ পরিস্থিতি পুরো বিশ্বজুড়ে বিরাজমান। এর মধ্যে সাব–সাহারান আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি মেয়ে শিশু আক্রান্ত হয়েছে। সাব–সাহারা অঞ্চলে এই সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ। এছাড়া পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় সাড়ে ৭ কোটি এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ৬ কোটি ৮০ লাখ। গবেষণায় আরও প্রতিফলিত হয়েছে, যেসব এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভঙ্গুর সেখানে যৌন সহিংসতা বিশেষভাবে বেশি। এমনকি ছেলেশিশুরাও এই সহিংসতা থেকে রেহাই পায়নি। এগারো জনের মধ্যে একজন ছেলে শিশু ও পুরুষ তাদের শৈশবকালে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যার সংখ্যা ২৪ কোটি থেকে ৩১ কোটির মধ্যে। অনলাইন ও মৌখিক যৌন সহিংসতাকে বিবেচনায় নেওয়া হলে ভুক্তভোগী ছেলে শিশুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ কোটি থেকে ৫৩ কোটির মধ্যে।
বিজ্ঞজনের মতে, ব্যাপক জৈবিক–সাংস্কৃতিক–শ্রেণিগত ও নগর–গ্রাম কেন্দ্রিক বিরাজিত আর্থ–সামাজিক বৈষম্যের অসম কারণে উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সহিংসতার মূলে পুরুষদের জৈবিক তাড়নার চেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসংগতি প্রণিধানযোগ্য। অনেক ক্ষেত্রে নানামুখী সামাজিক কলঙ্ক মোচনের দায়মুক্তি হিসেবে ধর্ষণের ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় না বা করা হয় না। মূলত: সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিম্ন আয়ের পেশাজীবী নারী–পোশাক শিল্প কর্মী–দরিদ্র স্বল্প শিক্ষিত ছাত্রী–গৃহবধু–আদিবাসী নারী সবচেয়ে বেশি এ ধরনের পাশবিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এইসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন থাকলেও তা নিরোধ করা যাচ্ছে না। সর্বোপরি সাক্ষীর অভাব, ভিকটিমের পরিবারের দারিদ্রতা, ভয়–ভীতি, অপরাধীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, ধর্মীয় পরিচয় এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একসময়ে উক্ত অপরাধের মামলাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বিচার ও শাস্তি ছাড়াই অনেক আসামি পার পেয়ে যায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মানিত স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সারা দেশে প্রশাসন–পুলিশ–আইনজীবী–কাউন্সিলর ও তরুণ সমাজের সমন্বয়ে ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ (দ্রুত সাড়াদানকারী দল) গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানান, ‘যে কোন মূল্যে নির্যাতন কমিয়ে আনা এ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।’ আইন প্রয়োগের যথার্থ কার্যকারিতা–শিথিলতা আদালত থেকে অপরাধীদের অতিসহজে মুক্ত হয়ে আসার পথ উন্মুক্ত করে। নানামুখী অশুভ কূটচাল দ্রুততর সময়ের মধ্যে নৈর্ব্যত্তিক ধারণা–বোধদয়ে প্রোথিত করা না হলে এর ব্যাপকতা সমাজকে ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছে দেবে। দেশ ও জাতিকে সামগ্রিক অর্থে কঠোর অন্ধকার গহ্বরে নিপতিত করার পূর্বে উপরোল্লেখিত অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। অন্যথায় যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণে সময়ক্ষেপণ বা ব্যর্থতা জাতিকে কঠিন সংকটে নিপতিত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী