নারীশিক্ষার অগ্রদূত

সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ জরিনা আখতার

ফারহানা পপি | সোমবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে অসংখ্য শিক্ষক তাদের নিরলস শ্রম, সততা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষকেরা সবসময়ই আমাদের জীবনের বিশেষ মানুষ। সুশিক্ষিত মানুষমাত্রই গভীর শ্রদ্ধার সাথে শিক্ষকদের স্মরণ করে থাকেন। ছাত্রজীবনের বিশেষ সময়ে জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়া শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তেমনই একজন ব্যতিক্রম শিক্ষক হলেন জরিনা আখতার ম্যাডাম। সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পরবর্তীতে সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।

সীতাকুণ্ডের নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এই বিদ্যালয় একটি মাইলফলক। ১৯৯৪ সালে বিদ্যালয়টির পাঠ্যক্রম দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় এবং সীতাকুণ্ড বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ হিসেবে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের অসংখ্য মেয়ের জন্য কলেজে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আরো একধাপ এগিয়ে স্নাতক স্তরে উন্নীত হয়। তখন থেকে এটি পরিচিত হয় সীতাকুণ্ড মহিলা কলেজ নামে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়, পাশাপাশি যোগ হয় নতুন শিক্ষা কার্যক্রম। জরিনা আখতার ম্যাডামের দূরদর্শী নেতৃত্বে কলেজটি সীতাকুণ্ডের অন্যতম সেরা কলেজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অবশেষে দীর্ঘ পথচলার পর ২০১৮ সালে সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। নতুন নাম হয় সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজ। এই যাত্রা শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং সীতাকুণ্ডের হাজারো নারীর শিক্ষার আলো পাওয়ার সংগ্রামের গল্প।

দূরগ্রামের মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি কলেজ ক্যাম্পাসেই একটি ছাত্রীনিবাসের ব্যবস্থা করেন। তিন কক্ষবিশিষ্ট ছাত্রীনিবাস ’বিজয়িনী হল’। যাতে মেয়েরা এখানে অবস্থান করে একাগ্রচিত্তে এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরাও তাদের পড়াশোনা নিবিড়ভাবে তদারকি করতে পারেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে অধিভূক্ত হওয়া ডিগ্রি ক্লাসের কার্যক্রম শুরু হলে শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতায় নিরূপায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীনিবাসটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। ছাত্রীনিবাস স্থাপনের এই উদ্যোগ নারীশিক্ষা প্রসারে তাঁর আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।

সময়নিষ্ঠতা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে তিনি ছাত্রীদের অন্তর্গত প্রতিভাকে পরিষ্ফুটন ও বিকাশে সহায়তা করতেন। তেমনিভাবে কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সহকর্মীদের মাঝে সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য উদ্দীপনা তৈরি করতে সমর্থ হন। আমার মেঝো আপা, সেলিনা আখতার, যিনি দীর্ঘদিন তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, প্রায়ই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেনকীভাবে ম্যাডামের দিকনির্দেশনা তাঁদেরকে সঠিক পথ বেছে নিতে সহায়তা করেছে।

ম্যাডাম সবসময় সাদা শাড়ি আর মাথায় কালো ক্যাপ পরতেন, যা আমাদের কাছে এখনও সততা আর দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে আছে।

তিন দশকেরও অধিক সময় আগে স্কুল ত্যাগ করেছি। কিন্তু আজও গভীরভাবে অনুভব করিতিনি আমার জীবনের প্রিয় শিক্ষকই শুধু নন, তিনি আমার প্রিয় মানুষদের একজন। আমি তাঁর কাছ থেকে শুধু শিক্ষা নয়, একটি জীবনদর্শন পেয়েছি। আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি এমন একজন শিক্ষককে পাওয়া, যিনি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছেন, আমার আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছেন আর শেখার আনন্দকে আজীবনের সঙ্গী করেছেন।

সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি আমাকে একটি কবিতার খাতা তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথম পাতায় নিজ হাতে লিখে দিলেন সুকুমার রায়ের শিশুতোষ ছড়া, ’রাম গরুড়ের ছানা, হাসতে তাঁদের মানা।’ তিনি ছড়াটি শুধু মুখস্থ করিয়ে ক্ষান্ত হননি, বরং দেখিয়েছিলেন কীভাবে প্রতিটি শব্দ শরীরের ভঙ্গি, হাত ও মুখভঙ্গির মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলতে হয়।

কয়েকবছর পর, যখন আমি স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে জীবনের আরেকধাপে পা রাখতে চলেছি, তখন তিনি সেই কবিতার খাতায় লিখে দিলেন রবাট ফ্রষ্টের সেই বিখ্যাত দার্শনিক কবিতা The road not taken । ম্যাডামের উৎসাহে স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি মঞ্চে উঠলাম ইংরেজি কবিতাটি আবৃত্তি করতে। Two road diverged in a yellow wood .\ And sorry I could not travel both…. I took the one less traveled by/ And that has made all the difference. আবৃত্তি শেষে আমার চোখে পড়েছিলো একজোড়া স্নেহমাখা দৃষ্টিতাঁর চোখ ভালোবাসা, গর্ব আর বিশ্বাসের জলে ভরে গেছে। বুঝলাম, তিনি শুধু পাঠ্যক্রম শেখাচ্ছেন নাতিনি আমাদের জীবনের সঠিক পথ দেখাচ্ছেন।

সেই কবিতার খাতাটি আমার জন্য একটি অমূল্য সম্পদযেখানে প্রতিটি পঙক্তির সাথে জড়িয়ে আছে আমার প্রতি একজন মানুষ গড়ার কারিগরের বিশ্বাস, স্নেহ আর অনুপ্রেরণা। আমার শৈশবকৈশোরের স্মৃতিতে প্রধান শিক্ষিকার সেই তারুণ্যদীপ্ত মুখ সবর্দাই সমরূপে উজ্জ্বলদীপ্তিময়।

ম্যাডামের শিক্ষাদানের ধরনও ছিলো অন্যরকম। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। পাঠ্যবইয়ের পড়া শেষ হলে শোনাতেন অসমাপ্ত গল্প। কখনো ‘প্রিন্সেস বেলাবেল’ কখনো ‘রাজার মাথায় না দুটো শিং’। আমরা সবাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গল্প শুনতাম আর পরের অংশ শোনার জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতাম। সেই গল্পের অপেক্ষা আমাকে শিখিয়েছেশেখার আনন্দই শিক্ষার আসল প্রেরণা।

শুধু আমি নইপ্রতিটি ছাত্রীই তাঁর কাছ থেকে সাহস, স্বপ্ন এবং সৎ মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। তিনি শুধু পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বির্তক, উপস্থিত বক্তব্য, আবৃত্তি, গার্লস গাইডসহ অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে। তিনি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বদলে দিয়েছিলেন নতুন চিন্তা দিয়ে।

ছাত্রীদের ম্যাডাম সম্বোধন করতেন-‘আমার মেয়েরা’ । সম্বোধনেই দূর হয়ে যেত তাদের ভীতিআতংক। শিক্ষকশিক্ষার্থীর মানসিক এই নৈকট্য দুরূহ পাঠ্যবিষয়কেও সহজ করে দিতো। প্রতিটি ছাত্রীকেই তিনি পৃথকভাবে চিনতেন। সময়ের চেয়ে অগ্রসর একজন প্রগতিশীল নারী শিক্ষক তাঁকে ঘিরে থাকা শিশুকিশোরীদের চোখে ভবিষ্যৎ গন্তব্য এঁকে দিতেন। তরুণীদের হৃদয়ে স্বপ্নবান হওয়ার প্রত্যয় জাগাতেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি একজন রোল মডেলযিনি হাজারো নারীর জীবনে আলোর রেখা হয়ে আছেন।

জরিনা আখতার ম্যাডাম তাঁর ছাত্রীদের বলতেন-‘পৃথিবী একটি শক্ত পাথর। যদি আমরা এই পাথরে দাগ কাটতে পারি, মানুষ আমাদের মনে রাখবে।’ তিনি সেই আলো ছড়ানো ফসফরাস পাথর, যিনি নিজের জীবনে এক একটি দাগ কেটেছেনসততায়, দায়িত্ববোধে,শৃঙ্খলায় এবং মানবিকতায়।

প্রায় চার দশক সময় ধরে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি শুধু বই পড়াননি, তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার দিশারী, সহকর্মীদের প্রেরণার উৎস এবং স্থানীয় সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তিনি শিখিয়েছেন সততা, সৎ সাহস, নৈতিকতা। তিনি গড়েছেন মানুষ। আলোকিত করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাঁর হাতে গড়া হাজারো শিক্ষার্থী আজ ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশজুড়ে। আছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, সমাজকর্মী

এক সাক্ষাতকারে কলেজকে ঘিরে তাঁর কিছু পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখতেনভিকারুন্নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের মতো সীতাকুণ্ডে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একাধিক ক্যাম্পাস হবে। বলতেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজের পৃথক ক্যাম্পাস খোলা জরুরি। নারী মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপযুক্ত প্রেক্ষাপট আর তৈরি হয় না। ২০১৯ সালে জরিনা আখতার ম্যাডাম সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদ হতে অবসর নেন। চিরদিনই নিভৃতচারী ব্যক্তিত্ব। অবসর গ্রহণের পরবর্তী বছরগুলোতেও তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই দিনযাপন করছেন।

জরিনা আখতার ম্যাডাম হাজারো শিক্ষার্থীর জীবনের ভিত রচনা করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উত্তরণে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অবশ্যই জাতীয় পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার। জাতীয় স্বীকৃতি ভিক্ষা নয়এটি তাঁর প্রাপ্য সম্মান। আমরা যদি নিরব থাকিভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সততা, শৃঙ্খলা ও ত্যাগের কোনো মূল্য থাকবে না। তাই আমাদের দৃঢ় দাবি :

. কলেজের একটি ভবনের নাম জরিনা আখতার ভবন করা হোক।

. তাঁর নামে বৃত্তি ও স্মৃতিপদক চালু করা হোক।

. তাঁকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক।

জাতীয় স্বীকৃতি শুধু তাঁর জন্য নয়, এটি হবে শিক্ষা ও নৈতিকতার জয়গান। আজ সময় এসেছে তাঁর প্রাপ্য সম্মান আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আবেদন করার। প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী, সহকর্মীবৃন্দ এবং শিক্ষানুরাগী স্থানীয় জনগণ যদি এগিয়ে আসেন তবে একজন নারীশিক্ষার অগ্রদূত তাঁর যোগ্য সম্মান পাবেন।

এটি কেবল একজন শিক্ষকের স্বীকৃতি নয় বরং নিবেদিত প্রাণ প্রতিটি শিক্ষকের জন্য একটি প্রেরণা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুত্রের জন্য শোকগাথা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে মূকাভিনয় কর্মশালা