নারীশক্তি-শেকল ভেঙে শিখরে

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ

বছর ঘুরে আবার যখন ক্যালেন্ডারের পাতা বদলায়, তখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় দু’টি আয়না। একটিতে বিগত বছরের ধুলোবালি আর ঘামের দাগ, অন্যটিতে আগামীর অস্পষ্ট কিন্তু মায়াবী এক স্বপ্নরেখা। নারী জীবনের জন্য এই পালাবদল কেবল তারিখের পরিবর্তন নয়, বরং এক নিরন্তর যুদ্ধের সাময়িক বিরতি এবং নতুন রণকৌশল সাজানোর লগ্ন।

একটি বছর শেষ হওয়া মানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নারীর অবস্থানের একটি খতিয়ান তৈরি করা। বিগত বছরটি বিশ্বজুড়ে এবং বাংলাদেশে নারীদের জন্য ছিল একাধারে সংগ্রামের ও অর্জনের। সেই অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের নতুন বছরের পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির খতিয়ানে পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি এক মিশ্র অনুভূতির সমাহার। গেল বছরেও আমরা দেখেছি ঘর আর বাহির সামলাতে গিয়ে কত অগণিত নারী নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছেন হাসিমুখে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হেঁশেল সামলানোর লড়াই থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা ছিল পাহাড়সম।

তবে কেবল বেদনাই শেষ কথা নয়। আমরা দেখেছি নারী ফুটবলারদের জয়োল্লাস, উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের অভাবনীয় উত্থান এবং প্রতিকূলতার দেয়াল ভেঙে সাধারণ নারীদের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। ফেলে আসা বছরের প্রতিটি চোখের জল যেমন আমাদের ক্লান্ত করেছে, তেমনি সেই জলই আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে মরুভূমিতেও ফুল ফোটাতে হয়। নতুন বছর মানেই একগুচ্ছ আশা। এই আশাটা কেবল বেঁচে থাকার নয়, বরং মাথা উঁচু করে বাঁচার। আমাদের প্রত্যাশা হোক আত্মনির্ভরশীলতার। নিজেকে ভালোবাসার শপথ নিতে হবে এবার। সংসারের সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজের মনের যত্ন নিতে ভুলে যাওয়া চলবে না।

গেল বছরে বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জও ছিল প্রকট।

বিবিএসএর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪২.৬৮% এ দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ইকমার্স ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও ডিজিটাল জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। নতুন বছরে আমাদের বড় প্রত্যাশা এমন এক সমাজ যেখানে পথ চলতে নারী ভয় পাবে না, যেখানে শ্রদ্ধা হবে লিঙ্গনিরপেক্ষ।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব সরাসরি নারীর ওপর পড়েছে। এছাড়া সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের হার বিগত বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

বর্তমানে নারীরা এক অদ্ভুত দ্বিমুখী সংকটে দাঁড়িয়ে। একদিকে ডিজিটাল বিপ্লব যেমন নতুন সুযোগের দুয়ার খুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে সাইবার অপরাধ, রাজনীতির মানসিক চাপ এবং কর্মক্ষেত্রে সূক্ষ্ম বৈষম্য এক নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ এখনো গৃহস্থালি কাজ আর বাইরের পেশার ভারসাম্য রক্ষার পুরো দায়ভার নারীর কাঁধেই চাপিয়ে রাখছে। বর্তমান বাস্তবতা বলছে, নারী কেবল এগিয়ে যাচ্ছে না, বরং প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে নতুন ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

নতুন বছরের প্রত্যাশা, যেখানে আমাদের নজর দিতে হবে নতুন বছরে আমরা কেবল আশা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখতে চাই।

পথ কঠিন হবে, এটাই আগামীর পরম সত্য। তবে এই কাঠিন্যই নারীর ভেতরের অপ্রতিরোধ্য সত্তাকে জাগিয়ে তুলবে। আগামীর স্মার্ট পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কেবল প্রথাগত শিক্ষা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন হবে প্রযুক্তিতে সর্বোচ্চ দক্ষতা এবং প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করার মানসিক দৃঢ়তা।

পুরোনো বছরের সবটুকু গ্লানি আমরা ধুয়ে ফেলতে চাই আগামীর প্রত্যয়ে। নারীরা এখন আর কেবল মমতাময়ী মা বা গৃহিণী পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নেই। তারা এখন নীতিনির্ধারক, তারা এখন পরিবর্তনের কারিগর। বিগত বছরের প্রতিটি ‘না’ শব্দ যেন নতুন বছরে ‘হ্যাঁ’ হয়ে ফিরে আসে জোরালোভাবে।

আসুন, নতুন বছরে আমরা অঙ্গীকার করি, আমরা আর থামব না। প্রতিটি নারীর ভেতরে যে অদম্য শক্তি ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে তোলার নামই হোক নতুন বছর। অতীত আমাদের শিখিয়েছে লড়াই করতে, আর ভবিষ্যৎ আমাদের বাধ্য করবে আরও শক্তিশালী হতে।

শীতের রিক্ততা শেষে বসন্তের আগমনী বার্তার মতো প্রতিটি নারীর জীবনে আসুক স্বস্তি, সাফল্য আর অসীম আনন্দ।

আগামী বছরটি তাই কেবল নিছক উদযাপনের নয়, বরং নিজেকে আরও যোগ্য করে গড়ে তোলার এক অগ্নিপরীক্ষার বছর। কণ্টকাকীর্ণ এই পথেও নারীরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে নতুন ইতিহাস লিখবেএই প্রত্যাশাটুকুই হোক আমাদের নববর্ষের অঙ্গীকার।

আমাদের নতুন বছর হোক সম্ভাবনার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেষের যাত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে হাতির হামলায় কৃষকের মৃত্যু