নারীর সাজসজ্জা ও আত্মমর্যাদা

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী (রুনা) | শনিবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

নারীর সাজসজ্জা তার প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ। কিন্তু তা যদি অতিরঞ্জিত হয় তখনই কিছু প্রশ্ন চলে আসে। চলে আসে সাজসজ্জার সাথে তার আত্মমর্যাদার বিষয়টি।
উচ্চশিক্ষা ও পোস্টিং এর সুবাদে দীর্ঘ অনেক বছর দেশের বাইরে থাকার সুযোগ হয়েছে। সেই সাথে কিছু প্রশিক্ষণের জন্যেও কয়েকবার দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতার সুবাদে আমার মনে হয়েছে-বাংলাদেশে নারীর সাজসজ্জায় অতিরঞ্জন রয়েছে। আর সে অতিরঞ্জন প্রতিনিয়ত: নারীর আত্মমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। কিভাবে? কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
প্রথমত: এদেশে নারীর গায়ের রঙ ফর্সা কিনা-এ নিয়ে যে বাড়াবাড়ি চলে তা আর কোথাও দেখা যায় বলে মনে হয় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দেশের মানুষ খুবই বর্ণবাদী। ত্বক ফর্সাকারী বিভিন্ন ক্রিমের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সাবানের অনেক বিজ্ঞাপন আছে যেখানে নারীর সৌন্দর্য বলতে কেবল ফর্সা হওয়াকেই বোঝায়। অথচ এসব বিজ্ঞাপন যে নারীর মর্যাদার জন্যে হানিকর এটা অনেক নারীই বুঝতে পারে না। তারাও চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে মরিচীকার মতো সেই প্রোডাক্টগুলোর পেছনে ছুটতে থাকে এবং ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। আল্লাহ্‌’কে অশেষ ধন্যবাদ আমাকে কখনো এসব চটকদার জিনিস প্ররোচিত করতে পারেনি। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত যা কিছু তাতেই আমি পরিতৃপ্তি খুঁজে পেয়েছি এবং পাই, আমার আমিত্ব’কে ধরে রাখার চেষ্টা করি।
দ্বিতীয়ত: এদেশে নারীরা যে কোনো উছিলায় বিউটি পার্লারে না সাজলে, ভারী সাজ না নিলে যেন শান্তি খুঁজে পায় না। আর এ কারণে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিউটি পার্লার গজিয়ে উঠেছে। অনেকেই হয়তো বলবেন এতে অনেক নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু ‘কোয়ালিটি এনশিউর’ করছে এমন বিউটি পার্লারের সংখ্যা খুবই হাতে গোনা।
সারা পৃথিবীতে রয়েছে নারীদের ‘হেয়ার কাট’ এর জন্যে সেলুন এবং ‘কসমেটিক ট্রিটম্যান্ট’ (পেডিকিওর, মেনিকিউর, ইত্যাদি) এর ব্যবস্থা। এসব দেশে যার যার সাজ- সে নিজেই করে (কিছু রয়েল ফ্যামিলি ছাড়া)। কিন্তু এদেশে সাজসজ্জার জন্যেই মূলত: বিউটি পার্লারের জমজমাট অবস্থা। ব্যক্তিত্ব গঠনের চেয়ে ভারী সাজের মাধ্যমে সুন্দর হওয়ার প্রতিযোগিতায় রয়েছে এদেশের অধিকাংশ নারী। বিউটি পার্লারের এ ভারী সাজসজ্জা, নারীর সৌন্দর্য বাড়ানোর পরিবর্তে নারীর মর্যাদাকে আঘাত করে বলে আমি মনে করি। কেন? বলছি।
আমার এ জীবনে কিছু কাছের মানুষের চাপে পড়ে দু’বার আমাকে বিউটি পার্লারে সাজতে হয়েছিল। এ দুবারের অভিজ্ঞতা আমার অনুভূতিকে ভীষণ রকম নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল- আমি যেন নিজের ওপর বিশেষ করে আমার ত্বকের ওপর অত্যাচার করছি এবং সে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আমার ত্বক যেন নি:শ্বাস নিতে পারছে না। অন্যদিকে মনে হয়েছে- আমি যেন এ ভারী সাজে আমাকে হারিয়ে ফেলেছি, আমি এই আমিকে যেন চিনতে পারছি না। এই দুই অনুভূতি- আমাকে এত বেশি নাড়িয়ে দিয়েছিল আমি হাজারও চাপে (‘পিয়ার’ কিংবা ‘ফ্যামিলি মেম্বার’- যেই হোক) আমার আমিত্বকে বিসর্জন দিতে পারি না। আমি ঐ দু’বার ছাড়া আমার এ জীবনে কখনও বিউটি পার্লারে সাজতে যাইনি। এমনকি আমি নিজে সাজার সময়ও ভারী সাজ পরিহার করি।
ছোট-বড় সব অনুষ্ঠানে নারীদের এই ভারী সাজের প্রতিযোগিতা কয়েকটি বার্তা দেয়। এক, যে সব নারীরা ‘ইনসিকিওরিটি’ বা ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ এ ভোগে তারাই কেবল বিউটি পার্লারে যায় এই ভারী সাজের জন্যে এবং এর মাধ্যমে ‘আর্টিফিসিয়াল’ ও ‘ইমপোজ’ করা সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। দুই, বিউটি পার্লারের এ সাজে একটি নারীর সৌন্দর্যে ‘ন্যাচারাল বিউটি’র পরিবর্তে কৃত্তিমতার পরশ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিউটি পার্লারের সাজ- মানুষের চেহারা অনেক বেশি পাল্টে দেয় এবং তা তোলার পর যে চেহারা বেরিয়ে আসে- এ দুই এর মাঝে থাকে বিস্তর ব্যবধান। ফলে এটি এক ধরণের প্রতারণাও বটে। তিন, নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে কি সাজ যায়, সেটা একজন নারী নিজে যতটা বুঝবে, অন্যের পক্ষে সেটা পুরোপুরি বোঝা কি আসলেই সম্ভব? আমার তো মনে হয় যিনি সাজান- তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে সেই সাজে। এতে যিনি সাজলেন- তার নিজের স্বকীয়তার কোন প্রতিফলন থাকেনা।
সারাজীবন বিশ্বাস করেছি- নারীর সৌন্দর্য তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বে। সেটি চর্চা করলে নারীর ভারী সাজের প্রয়োজন পড়ে না, হাল্কা সাজেই নারীকে অপরূপা দেখায়।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅহনের গল্প
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে