নারীর সমতা ও ন্যায় : এক অসমাপ্ত অভিযাত্রা

ফজলুল কবির মিন্টু | বৃহস্পতিবার , ২১ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারী ও পুরুষের অবদান সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবতায় এই সমতা আজও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা দেখি, নারী শুধু পরিবার গঠনে নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তবুও সামাজিক ও কাঠামোগত বৈষম্য তাদের সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন ‘এই বিশ্বে যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছেন নারী, অর্ধেক তার নর’ যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, নারীর পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সভ্যতা, কোনো উন্নয়ন, কোনো কল্যাণই সম্পূর্ণ হতে পারে না।

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার চর্চা ও সমতার প্রশ্নে বারবার একটি বিষয় উঠে আসে নারীকে এখনো সমান অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা মানব ইতিহাসের আদিকাল থেকেই বৈষম্যের বহমান ধারারই অংশ। অথচ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১ ও ২তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।’ কিন্তু বাস্তব চিত্র কি সত্যিই এই ঘোষণার প্রতিফলন ঘটায়?

নারীর অধিকার নিয়ে বিশেষভাবে গৃহীত সিডও সনদে ১ম ১৬টি ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যের ধরনসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে বৈষম্য দূর করার জন্য আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই সনদকে সচেতনভাবেই ‘নারীর মানবাধিকার সনদ’ বলা হয়নি, বরং নারীর মানবধিকার ও নারী অগ্রগতির প্রশ্নে প্রধান অন্তরায় হিসাবে সমাজে বিদ্যমান নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সমূহ চিহ্নিত করে তা হ্রাস করতে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই সনদে। বিশেষত সিডও সনদের ২য় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় আইনে নারীর সমঅধিকারের বাধা সমূহ চিহ্নিত করে তাকে সংস্কারের আহ্‌বান জানানো হয়েছে, এবং ১৬()() ধারায় পরিবারে নারীর অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

এ কথা আজ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়প্রধানত বৈষম্যের কারণেই সমাজের প্রতি ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আইএলও কনভেনশন ১০০ ও ১১১, জাতি সংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার গোল ৫ ও ৮, শ্রম আইনের ধারা ৩৪৫, এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ সবখানেই ধর্ম, বর্ণ এবং লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য হ্রাস ও সমতার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারপরও সমাজে, রাষ্ট্রে ও কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা।

এ বৈষম্যের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও আশঙ্কাজনক। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের ২০১৭ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাত্র ৮ জন ব্যক্তির হাতে রয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদ। বিগত ৮ বছরে বৈষম্যের মাত্রা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় বৈষম্য পরিমাপের অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে গিনিসহগের সূচক ১৯৭৩ সালে যেখানে গিনি সহগ ছিল ০.৩৮, ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৮। অনুমান করা হয় বর্তমানে তা ০.৫ ছাড়িয়ে গেছে, যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছরগুলোতে ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে, যা গিনি সহগ বৃদ্ধির দাবিকে যথার্থতা প্রমাণ করে।

এই আয় ও সুযোগ বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি শ্রমবাজারেও স্পষ্ট। দেশে প্রায় আট কোটি শ্রমিকের মধ্যে ৮৭% অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং মাত্র ১৩% প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। বলা বাহুল্য, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা শ্রম আইনের সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং তাদের অন্তত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমরা এবারের বাজেটে লক্ষ করেছি, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলের অনুদানের উপর ১০ শতাংশ কর ধার্য করে সরকার যেন তার দায়িত্ব পালনে উল্টো পথে যাত্রা করেছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রম খাতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ মাত্র একতৃতীয়াংশেরও কম, যা স্পষ্টতই নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সীমিত সুযোগকে নির্দেশ করে। এটি কেবল সামাজিক বা ধর্মীয় বাধার ফল নয়, বরং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবও এর জন্য দায়ী।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার ৮ নম্বর গোল ‘শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ এর অন্যতম ভিত্তি হলো সমান Employment Opportunity। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কম হওয়া মানেই এই লক্ষ্য লঙ্ঘিত হচ্ছে। উল্লেখ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার মূল স্লোগান হচ্ছে ‘No one left behind’ কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার বিপরীত।

২০২৪ সালের গণআন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি বৈষম্যহীন, সাম্য ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। শুধু তাই নয় আমরা যদি ইতিহাসের আরো একটু পিছনে ফিরে দেখি, ১৯৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেকটি জাতীয় জাগরণেই জনগণের চাওয়া ছিল একটিই তা হচ্ছে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ সেই স্বপ্নে বুক চিতিয়ে বার বার লড়াই করেছে, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে কালো রাজপথ লাল রঙে রঞ্জিত করেছে, প্রাণ হারিয়েছেন বাংলা মায়ের হাজারো সাহসী সন্তান কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দীর্ঘ চুয়ান্ন বৎসরের পথ পাড়ি দিয়েও আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্ন আজো স্বপ্নই রয়ে গেছে বাস্তবতার মুখতো দেখেইনি। বরং বৈষম্যই যেন আজ সর্বস্তরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই বৈষম্য থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে প্রথমত, নারীর অধিকারকে মানবাধিকার চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে এবং নারীর প্রতি বৈষম্যকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আইন সংস্কার, প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং সামাজিক সচেতনতা এই চারটি স্তম্ভকে সক্রিয়ভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই আসুন আমাদের চুয়ান্ন বৎসরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলি ‘আর বিলম্ব নয়, বরং এখনই শুরু হোক বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের এক নতুন প্রত্যয়’।

লেখক: টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিভাসু ৭ একরে সীমিত, কিন্তু স্বপ্ন বিস্তৃত
পরবর্তী নিবন্ধজল-জোছনার শহরে কবরস্থানসমূহ