নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করা জরুরি

অর্থনৈতিক উন্নয়ন :

| মঙ্গলবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

আমরা জানি, আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশে কুটির শিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা যেমন রয়েছে, তেমনি তার বিস্তার ও বিকাশে রয়েছে তাদের ব্যাপক অবদান। চুন তৈরি, ঠোঙা তৈরি, বাঁশ ও বেত শিল্প, তাঁত বোনা, জাল বোনা, ছোবড়া শিল্প, মাদুর বোনা শিল্প ইত্যাদিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নকশিকাঁথা তৈরি, কাচ, মোম, শোলা ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন সামগ্রী তৈরির শিল্পে, ব্লক বাটিক, টাই ডাই ইত্যাদি শিল্পে প্রায় এককভাবে নারীরা অবদান রেখে যাচ্ছেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে ‘বুটিক’ শিল্পের মাধ্যমে যে নবজাগরণ এসেছে তাতে কুটির শিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে বহুগুণে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নারীর কর্মসংস্থানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭.২ শতাংশ নারীর মালিকানাধীন, যার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, আমাদের জাতীয় আয়ে এ খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। তাই এ খাতের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা নিজ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদেরও জীবিকার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং জাতীয় আয়ে অবদান রাখছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি সামপ্রতিক সময়ে ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির পাশাপাশি অন্তত দুই দশক ধরে প্রবাসী নারী শ্রমিকরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমেও দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত অভিবাসী নারী শ্রমিক ১ শতাংশের নিচে থাকলেও গত কয়েক বছরে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে মনে রাখা জরুরি যে শুধু শ্রমবাজার ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণই নয়, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে উচ্চ-উৎপাদক কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে নারীর শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আরো বাড়ানো সম্ভব। সে পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে কম বয়সে বিয়ে ও সন্তানধারণের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও প্রয়োজন সমন্বিত ও সুসংগঠিত উদ্যোগ। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের মতো পদক্ষেপের সঠিক বাস্তবায়ন, কর্মজীবী নারীদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসন ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা নারীকে মূলধারার শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করা জরুরি।
বলা জরুরি যে, নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যমতে, এক দশকের ব্যবধানে নারী প্রধান অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের মাত্র ৩ শতাংশ নারী প্রতিষ্ঠান প্রধান হলেও ২০১৩ সালে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। সুযোগ-সুবিধা ও নীতিসহায়তা পেলে নারীপ্রধান অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। বাজেটে করমুক্ত লেনদেনের বা আয়ের এ সীমা বাড়ানোর ফলে নারীদের কিছুটা হলেও সহযোগিতা হবে। তবে নারীদের জন্য আরো বেশি সুবিধা বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন নারী উদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী উদ্যোক্তাদের মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় বেশি আগ্রহ রয়েছে। পাশাপাশি গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্রাফটস খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) চালু করলে নারীদের অনেক সমস্যা দূর হবে। ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে মালামাল গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে নারীদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নারীদের অর্থায়ন বাধা দূর করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার এক ধরনের অদম্য মনোভাব। এ জন্য নারীদের দীর্ঘ লড়াই করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে