নারীর মর্যাদা ও নারীবাদিতা

করবী চৌধুরী | শনিবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমাজে আজকাল যত্রতত্র নারীবাদীদের দেখা মেলে। এদের পদচারণাটা আবার ফেসবুকেই একটু বেশি। নারীদের কিছু হলেই এরা পেছনের কিছু তলিয়ে না দেখেই নারীবাদের ঝান্ডা উড়িয়ে তিক্ত বাক্যবাণে পুরুষ নিধনে ব্রতী হয়। তাদের চোখে নারীরা সর্বক্ষেত্রেই নির্দোষ এবং বিনাদোষেই সদা-সর্বদা শাস্তি পায়।
নারীবাদের মূল সংজ্ঞা থেকে এই শ্রেণির অবস্থান আর ভাবনা-চিন্তাগুলো অনেকটাই তফাতে থাকে।
মূলত, নারীবাদী হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা অসহায় নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া সকল রকম শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ান, তাঁদের জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়ে যান এবং তাঁদেরকে সকল রকম অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বের করে এনে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন।
শুধুমাত্র নারীরাই যে নারীবাদী হবেন তা কিন্তু নয়, শুধুমাত্র ঝান্ডা উড়িয়ে আর সভা- সেমিনার করে নয়, দুর্গত, অসহায় নারীদের অধিকার লড়াইয়ে প্রকৃতভাবেই যাঁরা তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তাঁরাই হচ্ছেন নারীবাদী।
এক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। বরঞ্চ নারীরা যখন পুরুষদের পাশে নিয়ে নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সোচ্চার হন, তখন সেই লড়াইটা হয় আরো ফলপ্রসূ, আরো অধিক মানবিক। কোনো নারী সবসময় নারীবাদী চিৎকার করে গেলেই সেটা আলাদা কোন মর্যাদা বহন করবে না, যদি না তিনি সত্যিকারভাবেই নারীবান্ধব না হন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার জানা একটা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি।
একজন বিখ্যাত সমাজসেবী মহিলা যিনি নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত, অসহায় নারীদের জন্য কাজ করেন, কনফারেন্স করেন, পত্রিকায়, টিভিতে পুঁথিগত সমস্ত বুলি ঝেড়ে নারীবিরুদ্ধ সমাজের গোষ্ঠী উদ্ধার করেন, মেয়েদের দুঃখে যেন তার বুক ফেটে যায়, সেই তিনিই আবার বাসায় ফিরে কাজ ভুল করার অপরাধে কাজের ছোট মেয়েটাকে মারধর করেন।
অনুপস্থিতির জন্য বা কাজে একটুখানি গাফিলতির জন্য কাজের বুয়াটার বেতন কেটে রাখেন।
ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজেন অবস্থাপন্ন ঘরের ফর্সা আর কমবয়সী লক্ষীমন্ত একটা মেয়ে, যাকে তিনি মনের মত করে গড়ে নেবেন। অন্যভাবে বলা যায়, বৌমার উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন। ঘরেই থাকবে বৌমা। চাকরি করা যাবে না কারণ এটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।
তাহলে বুঝে দেখুন তো, বাহ্যিক জ্ঞানসমৃদ্ধ কিন্তু অন্তরে নীচ, হীনম্মন্য এসব নারীবাদীদের নিয়ে বাস্তবে নারীদের কোনো উপকার হবে কি?
আবার আরেক প্রকার নারীবাদী আছেন যারা দোষগুণ নির্বিশেষে নারীদের অবলা, নিরীহ, নির্দোষ প্রাণী প্রমাণে সদা ব্যস্ত থাকে। অন্যদিকে কিছু নারী আছেন যারা মুখে নারী-পুরুষ সমঅধিকারের জন্য লড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পশ্চাতে শুধুমাত্র নারী হবার দুর্বলতার সুযোগটুকু নিতে কিন্ত পিছ পা হয় না।
আমি কিন্তু নারীবাদের বিপক্ষে নই। কেউ নারীদের হীনম্মন্য বা তুচ্ছজ্ঞান করলে আমারও অন্তরাত্মা জ্বলে ওঠে। কিন্তু বাস্তবজ্ঞান আমাকে এটাই শিখিয়েছে যে, লিঙ্গ সমতার মাঝেই থাকে প্রকৃত শিক্ষা।
সকল পুরুষ যেমন ধর্ষক হয় না, নারী নিপীড়নকারী হয় না, তেমন সকল নারীও সর্বগুণসম্পন্না হয় না। উভয়ক্ষেত্রেই ভালো-মন্দ রয়েছে।
লিঙ্গ সমতার প্রসঙ্গে বলা যায়, যখন আমরা নারীরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার দাবি করে আসছি, সেই আমরাই আবার বাসে উঠে সংরক্ষিত সিট নিয়ে ঝগড়া করছি। লেডিস সিটে কোনো পুরুষ ভুল করেও যদি বসে তখন তাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেটা দখল করে নারী হবার সুযোগটা নিতে এতটুকু দ্বিধা করিনা। এইরকম দ্বিমুখীনীতি অনুসরণ নারীমুক্তির ক্ষেত্রে কোন সুফল বয়ে আনবে না।
আসলে, “নারীদের সম্মান করো” এই আপ্তবাক্যটিকে বাদ দিয়ে “সম্মানের যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান করো”, এই বাক্যটিকে যতদিন না নারীরা আপন মর্মমূলে গেঁথে নিতে পারছে, যতদিন না নারীরা তাদের দীর্ঘদিনের চর্চিত সুবিধাভোগী চরিত্রের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে, ততদিন সামাজিক নিষ্পেষণের হাত থেকে তাদের মুক্তি নেই।
একজন নারী হয়ে আমি কায়মনোবাক্যে সবসময় এটাই চাই যে, মেয়েরা যেন তাদের অধিকার সম্বন্ধে অবগত হয়, সচেতনতার সাথে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম্মানযোগ্য মানুষদের সম্মান দেয় এবং অন্যের কাছ থেকে তদ্রুপ সম্মান পেতে নিজেকে সঠিকভানে গড়ে তোলে। নারীবাদের বিরুদ্ধাচরণ যেমন মন্দকাজ, তেমনি নারীদের নিয়ে অতিশয়োক্তিও খুব একটা যে ভালো কাজ তা বলা যাবে না। ‘আমাদের সমাজে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ এই প্রচলিতবাক্যটিও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সঠিকই বলা যায়। কারণ, শাশুড়ি কতৃক বৌমা নির্যাতনের ঘটনা যেমন সমাজে সুলভ, তেমনি অনেক উচ্চশিক্ষিতা বৌমাদেরও দেখা যায়, যারা পরিবারের শ্বশুর-শাশুড়ি তথা বয়োজ্যেষ্ঠদের তাঁদের প্রাপ্ত সম্মানটুকুও দেয় না।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, আমরা যেমন ধিক্কার জানাবো নারী নিপীড়ক পুরুষদের, পাশাপাশি ধিক্কার জানাবো সেসব নারীকে, যারা নিজের বা স্বামীর অশীতিপর বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে।
আমরা একদিকে যেমন ঘৃণা জানাবো নরপিশাচ ধর্ষকদের, আবার অন্যদিকেও ঘৃণা জানাতে ভুলবো না যারা নারী হয়েও নারী নির্যাতন করে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রশ্নপত্র ফাঁস
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে