নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

মৃণালিনী চক্রবর্ত্তী | রবিবার , ৬ এপ্রিল, ২০২৫ at ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ

ভাবছি, জেন্ডারবৈষম্য তৈরি করে? না বৈষম্যকারী প্রবৃত্তি জেন্ডারে বৈষম্য তৈরি করে। প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। আর এই মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নারী ও পুরুষ। সৃষ্টির শ্রেয় উদাহরণ এই প্রকৃতি। সৃষ্টির আনন্দ প্রস্ফুটিত হয়, না হয় ব্যাহত হয়। তাহলে বৈষম্য মনোভাব থেকে আমাদের ফিরে আসা উচিত। জেন্ডার কর্ম ভাগ করেনি করেছে স্বার্থপ্রিয় মানুষ। সিংহভাগ কর্ম করেও অবমূল্যায়নের দ্বারা যারা দগ্ধ হয় তারা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েও শ্রেষ্ঠ জাতি উপহার দিতে পারে না। কারণ শিক্ষক পথপ্রদর্শক আনন্দদায়ী। যদি সমাজ সংসার থেকে সেই উপকরণ আত্মস্থে আন্দোলিত না করে তাহলে ঢেঁকি খেলার সামিল। একজন মা সন্তানের জীবনের প্রথম শিক্ষক। সেই গঠনমূলক ভাষা, পুঁথিগত, আচার আচরণ সবদিকের। তাহলে সে মায়ের মানসিকতা মানবিকতার রূপ পুষ্টিময় হবার জন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যদি পূর্ণ থাকে তাহলে ভক্তি ও আদর্শ সেখানে গজিয়ে উঠে বারবার এবং সৎ এর চাষ হয় সেখানে অনিবার্য। যখনই নারীরা শুধু হাঁড়িতে নয় তারা কৃষি শিল্প শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থনীতিতে হাত বাড়িয়েছে তখনই সমাজের দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। দুই হাতের কাজ যদি চার হাতে পরিণত হয়। মেধা মনন উন্নয়ন সেই দেশের দরজায় এসে কড়া নাড়ে নিশ্চিত। গুহায় বসবাসের জীবন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমাজ রাষ্ট্র, জীবন জীবিকার পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে নারী ও পুরুষের সংগ্রামের ইতিহাস। মালিক শ্রমিক, সাহেব বাদী, সহযোদ্ধা ইত্যাদি রূপে। আদিম সমাজে শ্রম বিভাজন ছিল স্বাতন্ত্রিক আহারের খোঁজে। দাস সমাজে নারীদের অবস্থান যখন যার তখন তার।

সামন্ত সমাজে এসে সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্র নীতিতে নারী নিপীড়নের নতুন নতুন প্রথার প্রচলন যেমন বাল্যবিবাহ, পর্দা ও সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলিত করা হয়। নারীরা মেধা মননে সক্রিয় ভূমিকা, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ পায়নি তখন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব অভিযানে সামন্ত সমাজের বিলুপ্ত হয়ে পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটে। নারীরা সরাসরি উৎপাদনে কৃষি শিল্প ও কুটির শিল্পের উন্মেষ ঘটায় তারপরও পরজীবী হিসেবে তারা উদ্ধৃতি ইঙ্গিতে অবস্থায়িত। সমাজ রাষ্ট্র প্রগতির জন্য নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সর্বাগ্রে অপরিহার্য। এই চেতনা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় বাধা নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু জেন্ডার বৈষম্য একপ্রকার চাপিয়ে দেওয়া শক্তি। শিল্প কারখানায় শ্রমজীবী মানুষ নারী পুরুষ যখন যুগ যুগ ধরে শ্রম বণ্টন শ্রমমূল্যায়নে বৈষম্যের শিকার ও আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তা অধিকার সংগ্রামে পরিণত হয়। নারীর বৈষম্য মুক্তি ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মানবাধিকার চর্চা প্রতিষ্ঠা সমাজ পরিবর্তনের চলমান গতিধারার মূল প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর সংগ্রামে বিচার্য। নীপিড়নমূলক আইন, রক্ষণশীলতা, পশ্চাৎপদতায় পরিণত করে সমাজকে সমাজ কাঠামোকে।

নারীর পরিবার, সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা পরিমণ্ডলে অবস্থান প্রান্তিক। বিরাজমান অন্যায়, অসঙ্গতি, সহিংস আচরণ, সর্বব্যাপী শোষণ শাসন বঞ্চনার বৈষম্যের শিকার এর বিরুদ্ধে উদ্যোগী ও সংগঠিত হয়ে নারীরা প্রতিবাদী হয়েছেন দশকে দশকে নির্মাণ করেছেন নারী শক্তির সংগঠিত বলয়। শ্রমমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সমমর্যাদা ও সমঅধিকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে।

পুঁজিবাদের আবির্ভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ বিজ্ঞান প্রযুক্তি, মেধায়, মননে দ্রুত এগিয়ে গেলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে বারবার আলোড়িত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলীর আবিষ্কার, কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশ, ১৮৫৭ সালে ডারউইনের বিবর্তনবাদী সূত্রাবলী পৃথিবীর সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দেয়। ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষ শ্রম অধিকার ও সমাজতান্ত্রিক চেতনায় দীক্ষা নিতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সূতাকলের নারী শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট ও প্রতিরোধ সংগঠিত করে। কর্তৃপক্ষ এই ধর্মঘট নির্মমভাবে দমন করে। এই শিল্প বিপ্লব সামন্তবাদী সামাজিক সংস্কার নামে নিপীড়ন থেকে নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অবমুক্ত করে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। এ পটভূমিতে শোষণের নগ্ন রূপ জেন্ডার বৈষম্য তীব্রভাবে সামনে চলে আসে। নারীরা এখন শিক্ষায় অর্থনীতি ও সামাজিক মর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকা রাশিয়া ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বিচ্ছিন্নভাবে নারী দিবস পালন হলেও ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক নারী কর্মীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেৎকিন ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ নিউইয়র্কে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের স্মরণে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে চলমান জেন্ডার বৈষম্যের শিকার শাসন শোষণ নির্যাতন বঞ্চনার শিকার নারী। আর পৃথিবীতে মানব মুক্তির নানা মাত্রিক সংগ্রামের একটি উদাহরণ ও শক্তিশালী দৃষ্টিপাত হলো নারী মুক্তির আন্দোলন। রাষ্ট্রায়ন, দেশ সংস্করণ, সমাজ সংস্করণ যাই বলুন না কেন নারীর মানবাধিকার মর্যাদার সংস্করণ না হলে উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। তাছাড়া আমরা দেখি ক্ষমতায়ন ছাড়াও নারীরা মমত্ববোধের শিখরে রাষ্ট্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন যুগযুগ ধরে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে নারীরা যুক্ত হয়েছিলেন যুদ্ধ করেছিলেন। তেমনি ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্য ইজ্জত ও প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ছিলেন। সমাজ, সংসার, শিক্ষা, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সকল কর্মকাণ্ডে নারী আজো অপ্রতিরোধ্য শক্তি।

নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় সিডও সনদ। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) এই সনদটি নারীর মানবাধিকার দলিল বলে স্বীকৃত।

মানুষ হিসেবে নারীর উন্নয়ন ও বিকাশের প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করার জন্য আইন প্রণয়ন।

প্রচলিত আইনের সংস্কার এবং আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি তথা প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপন। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দান। এই মূল কথাগুলোকে ধারণ করে তিনটি মৌলিক নীতিতে প্রতিষ্ঠিত সিডও সনদ।

() সমতার নীতি ( ) বৈষম্য হীনতার নীতি। () শরিক রাষ্ট্রের দায় দায়িত্বের নীতি। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার দলিলটিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পালনের বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত হয়।

জাতিসংঘ সনদের ১৬ নং ধারায় বিবাহসহ সকল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নারী পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা, ভোগ ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে নারী পুরুষের একই অধিকারের কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ বিচার বিশ্লেষণ বৈষম্যই ঘাতক ব্যাধি হিসেবে স্বীকৃত।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ