নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় করণীয়

শ্বেত জবা | শনিবার , ৫ জুলাই, ২০২৫ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বে যখন উন্নয়নের সূচক প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে তখনো বইছে স্তব্ধতার বাতাস। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম স্বাধীনতার সূত্রে গাঁথা। কিন্তু এত বছর পরও নারীদের নিরাপত্তা যেন গোলক ধাঁধারই প্রশ্ন মাত্র। নামে-বেনামে যত শত আইন কিংবা মজলিশ গঠন হয়েছে তার কোনোটাই সঠিকভাবে নারীকে সুরক্ষা দিতে পারেনি। কাঠামোগত উন্নয়নের হাত ধরে, পদ্ধতিগত সকল নীতির জেরে কেবল নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়।

পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে ভাসে দরজার আড়ালে, দরজা ভেঙে কখনো নির্বিঘ্নে জনসম্মুখেই নারীকে লাঞ্চনা করা হচ্ছে, ধর্ষণ-গুম-খুন, নির্যাতনও নিত্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তা অধিকার সংবিধান স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার, এর ব্যত্যয় ঘটলে রাষ্ট্র এর প্রতিকার করতে পারেন। রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো, নিরাপত্তা প্রদান, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ। তবে এখানে রাষ্ট্র বলতে কাঠামোগত সরকারকেই বোঝানো হয়। এর বাইরে একজন নাগরিক তার নিজ দায়িত্ব হিসেবে মান্যতা এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতে বাধ্য থাকেন কেবল।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নন্বর অনুচ্ছেদে একজন নাগরিক আইনি সহায়তা লাভের অধিকার রাখেন এবং ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা পান। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চার ক্ষেত্রে শর্ত হলো অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা, অন্যের ক্ষতিসাধন না করা এবং দেশ তথা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করা। তবে আমাদের বেশিরভাগই কেবল নিজস্ব ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চা করেন অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ভুলে গিয়ে। ফলে বর্তমানে প্রত্যেক নারীরই প্রয়োজন নিরাপত্তা রক্ষায় আইনি সুবিধা সম্পর্কে অবগত থাকা।

নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় আইনি সহায়তা পাবেন যেভাবে-

পুলিশে অভিযোগ ও জরুরি হেল্পলাইন

৯৯৯ (পুলিশের জরুরি নম্বর) এবং ১০৯ (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন হেল্পলাইনে) ফোন করুন।

নিকটস্থ থানায় (বিশেষ করে “নারী ও শিশু সেবা ডেস্ক”) যোগাযোগ করুন

আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Restraining Order )

পারিবারিক সহিংসতা বা হয়রানির ক্ষেত্রে দ্রুত “অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা” (Protection Order ) নেওয়া যায়।

এজন্য জেলা বা মহকুমা (Metropolitan ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হবে।

সরকারি বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা (Legal Aid )

জাতীয় লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন (NLASO ): ১০৯২৬ (হেল্পলাইন)

জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি (District Legal Aid Committee ) জেলা আদালতে যোগাযোগ করে বিনামূল্যে আইনজীবী প্রাপ্তি।

সরকারিভাবে স্বীকৃত আইনজীবীদের তালিকা জেলা আদালতে পাওয়া যায়।

এনজিও ও স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST )

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK )

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

নিজেরা করি, পুনারায় নারী উন্নয়ন কেন্দ্র ইত্যাদি।

এসব সংগঠন ফ্রি পরামর্শ, মামলা চালানো, সেফ হাউস ইত্যাদি সেবা দেয়।

আইনি পরামর্শ ও মামলা পরিচালনার ধাপ

ঘটনার বিস্তারিত (তারিখ, সময়, স্থান, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ) লিখে নিন।

থানায় First Information Report (FIR) বা Domestic Violence Act -এর অধীনে অভিযোগ দায়ের করুন।

আইনগত নোটিশ পাঠাতে চাইলে অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে Formal Notice পাঠান।

মামলায় আপনাকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেপারেট পরীক্ষা‐নিরীক্ষা, সাক্ষ্য‐প্রমাণসহ আদালতে হাজিরা দিতে হবে।

অনলাইন রিসোর্স ও হেল্পডেস্ক

NLASO ওয়েবসাইট (nlaso.gov.bd )

BLAST: blast.org.bd

ASK: askbd.org

এখানে আপনি অভিযোগ ফর্ম, আইনগত ম্যানুয়াল, নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের তালিকা পাবেন।

মনে রাখুন, নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় সচেতনতা আনতে হবে নিজেকে, এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রতিকূল পরিবেশে আত্মরক্ষা করতে হবে। জরুরি সেবা পেতে অবশ্যই হেল্পলাইনে ফোন করুন।

এছাড়াও আত্মরক্ষায় যেসকল সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারেন-

১. পেপার স্প্রে- চোখে মুখে পেপার স্প্রে করলে অন্তত ১৫-২০ মিনিট আত্মরক্ষার জন্যে সময় পাওয়া যায়। এছাড়া এটি স্বল্পমূল্যের, বহন উপযোগী।

২. পার্সোনাল সেফটি এলার্ম- ২৫০-৩০০ ডেসিবলের উচ্চ শব্দের সাইরেন ব্যবহারে পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করা যায়।

৩. ইলেক্ট্রিক স্টান গান- বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে আক্রমণকারীকে সাময়িকভাবে অচল রাখা সম্ভব। তবে আইনগত সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই এর ব্যবহার করা ভালো।

৪. মিনি পকেট নাইফ-এটি ব্যবহারে সতর্কতা জরুরী এবং আইনী সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে কেবল আত্মরক্ষায় ব্যবহার করুন।

যেসকল কাজ করতে পারেন-

১. কারাতে শেখা- আত্মরক্ষায় খুবই ভালো একটি প্রশিক্ষণ হলো কারাতে শেখা। এতে করে শারীরিকভাবে সবল থাকা যায়।

২. মোবাইল লোকেশন নির্ভরযোগ্য কাউকে শেয়ার করে রাখা-

যখনই কোনো নতুন পরিবেশে থাকবেন কিংবা আক্রমণের আশঙ্কা করবেন দ্রুত মোবাইল লোকেশন অন করুন এবং নির্ভরযোগ্য কাউকে শেয়ার করে রাখুন।

৩. মোবাইলে ভিডিও বা কোনো তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করুন- আক্রমণের আশঙ্কা হলে পরিস্থিতির ভিডিও করুন কিংবা বিশেষ কোনো তথ্য সংগ্রহ করে রাখুন। এতে করে পরবর্তীতে আইনি প্রতিকার পেতে সুবিধা হবে৷

সাধারণ এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যেখানে আমরা নিজেকে নিরুপায় ভাবি কিন্তু সদা সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া সুরক্ষা নিশ্চিত প্রায় অসম্ভব। ফলে নারীর সুরক্ষায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আলোচিত বিষয়গুলোও মাথায় রাখা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুক্তিবাদী মানসিকতা ছাড়া নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব নয়
পরবর্তী নিবন্ধচুপ করে বসে থাকার সময় নেই