স্বাধীনতার মাস মার্চ। এই মার্চেই গণমাধ্যমের সুবাদে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে একাধিক ক্ষমতায়িত নারীর দোর্দণ্ড প্রতাপ। উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত এই নারীগণ শিক্ষার শক্তি, দর্শন ও সৌন্দর্যকে ধারণ না করে কেবল সনদের জোরে লাভ করা ক্ষমতাকেই বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং সেই ক্ষমতার যথেচ্ছ প্রয়োগ করে সমাজকে এক ভয়ংকর বার্তা দিয়েছেন। এক নারী জেলা প্রশাসক তাঁকে ম্যাডাম না বলে আপা বলে সম্বোধন করায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে যেভাবে অপদস্থ করলেন তা দেখে থমকে গিয়েছে পুরো জাতি। নিগৃহীত শিক্ষকের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদের খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসক মহোদয় বেশ হাসিমুখেই একটা মীমাংসায় উপনীত হয়ে যান। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নারী বিচারকের কন্যার সদম্ভ উক্তি নতুন করে নাড়া দেয় আমাদের ঘুণে ধরা সমাজটাকে।
১৮৬৯ সনে স্থাপিত বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয় নারী শিক্ষায় অবদান রেখে চলেছে দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে। বিদ্যালয়ের কাজ কেবল সনদ লাভের পথ দেখিয়ে দেওয়া নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক জীবনের জন্য তৈরি করে দেওয়া। ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ঐতিহ্য অনেক কালের। ছাত্রীরা পালা করে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কারের দায়িত্ব পালন করে যায়। গেল ২১ মার্চের আগে এ নিয়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায় না। সেদিন শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কারের দায়িত্ব যার ছিল, সে তার দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানায়। কারণ সে একজন বিচারকের সন্তান। সে যে কেবল ঝাড়ু হাতে নিতে অস্বীকার করেছিল তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহপাঠীদের প্রতি তীব্র বিষেদগার ছুঁড়ে দিয়েছে। সহপাঠীদের ‘বস্তির মেয়ে’ বলে আখ্যায়িত করায় তার এতটুকু বাঁধেনি।
বান্ধবীদের সঙ্গে কোনো বিরোধ বা মতপার্থক্য তার থাকতেই পারে। আবেগ বা উত্তেজনার বশে অবিবেচকের মতো কিছু করার বয়স তার এখন। মা–ই পারতেন মেয়েকে নিবৃত্ত করতে, তাকে সংযত হওয়ার কথা বলতে, এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু তা না করে কেমন করে তিনি মেয়ের পক্ষ নিয়ে স্কুলে গিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের এত্তেলা পাঠান, আইনের রক্ষক হয়ে সাধারণ নাগরিকদের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় মামলা করার ভয় দেখান, তা বোধগম্য নয়। ভীতসন্ত্রস্ত অভিবাবক কন্যার শিক্ষাজীবন নিষ্কণ্টক করার আশায় ‘বিচারক’ অভিভাবকের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। নারী প্রধান শিক্ষকের দপ্তরে, তাঁরই উপস্থিতিতে এত কিছু হয়ে যায়। তিনি ভুলেই গিয়েছেন বিদ্যালয়ে তাঁর অবস্থানই সবার ওপরে। সেকারণেই তিনি প্রধান শিক্ষক। তিনি পারেন নি তাঁর ভূমিকায় অনড় থাকতে, অভিবাবকদের সম্মান রক্ষায় একটা সমঝোতায় উপনীত হতে। কাউকে অসম্মান করে যে আমাদের গৌরব বাড়ে না সে কথাতো বিচারক মা, নারী প্রধানশিক্ষক– কারোই অজানা থাকার কথা নয়। সাম্যের কবি নজরুলের সেই অমোঘ উক্তিটি মনে পড়ছে–
একজনে দিলে ব্যথা, সমান হইয়া বাজে সে ব্যথা সকলের বুকে হেথা
একের অসম্মান, নিখিল মানবজাতির লজ্জা সকলের অপমান। ছেলেবেলাতে আমাদের শেখানো হত–শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে তোলে; ফলবতী বৃক্ষ যেমন করে ফলভারে নুয়ে পড়ে, শিক্ষিত মানুষও তেমনি নুয়ে পড়ে জ্ঞানভারে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কখনও অন্যকে তার শিক্ষার দাপট দেখাবে না। কখনও অন্যদেরকে এই বলে হুংকার দেবে না যে– আমি উচ্চ শিক্ষিত, আমায় কুর্নিশ কর। অধস্তনদের এই বলে হুমকি দেবে না যে আমি তোমায় দেখে নেব, কিংবা জানো, আমি তোমার কী করতে পারি! আইনকে হাতের মুঠোয় পুরে সদম্ভে ঘোষণা দিতে পারে না যে তোমার নামে মামলা দেব, কিংবা তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব। বড়ই পরিতাপের বিষয়–নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের দেশের শিক্ষিত নাগরিকদের একটা বড় অংশ এখন তাদের সনদের জোরে, পদের জোরে, কিংবা অর্থের জোরে দম্ভোক্তি প্রকাশ করেন, যার জন্য তারা অনুতপ্ত হন না, লজ্জিতও হন না। সন্তানরাতো বাবা মাকে দেখেই শেখে।
মেঘনা পাড়ের এক অখ্যাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্কুল ঘর ও মাঠ পরিষ্কারে অংশগ্রহণ করার কথা মনে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ে – বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য শহর মেলবোর্নে থাকার দিনগুলোতে মেয়ের সঙ্গে তার স্কুল পরিষ্কারে অংশ নেওয়ার কথাও। স্কুলের প্রবেশ মুখে একটা তালিকা ঝুলানো থাকত, যেখানে বাবা–মায়েরা নিজেদের সুবিধামতো তারিখের পাশে নিজেদের নাম লিখে দিত। প্রতিদিন কোনো না কোনো মা কিংবা বাবা এই পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিতেন। শিশুটিও হাত লাগাতো আনন্দের সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে থাকত বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান। এইদিনে স্কুল মাঠের ঘাস লতা পাতা সাফ করা থেকে শুরু করে খেলার সামগ্রী, দরজা জানালা ধোয়া ও মোছা, এমনকি রঙ করার কাজও করে দিত কয়েক ঘরের বাবা–মায়েরা একজোট হয়ে। ছেলেমেয়েরাও সঙ্গ দিত এই কর্মযজ্ঞে। ছয় মাসের ব্যবধানে এক দিনের এই কায়িক পরিশ্রমে কেউ অসম্মানিত বা বিব্রতবোধ করেছিল বলে শুনিনি। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত এই কর্মযজ্ঞকে ‘ওয়ার্কিং বী’ বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সকল বিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যায় ‘ওয়ার্কিং বী’। তবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে ওয়ার্কিং বী’ তে সামিল হওয়ার আনুপাতিক হার অন্য দেশীদের তুলনায় অনেক কম, যা অভিবাসন সংক্রান্ত গবেষণায়ও উঠে এসেছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়– আমরা এসব ছোট কাজে (!) অভ্যস্ত নই।
আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে– গেল আট বছরে আমার মেয়েও সেইসব ছোট কাজ (!) করা দিনগুলোর কথা ভুলে গিয়েছে। ওর বর্তমান স্কুলে অন্তত দুই কুড়ি উর্দিধারী কর্মী নিয়োজিত থাকেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সেবায়। শিশুদের হাতে ঝাড়ু ওঠারতো প্রশ্নই আসে না, বরং অনেক অভিভাবক তাঁর সন্তানের বইয়ের ব্যাগ বহন করারও নির্দেশ দেন সর্বক্ষণ দণ্ডায়মান কর্মচারীদের, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে ক্রীতদাসের মতো হুকুম তামিলের অপেক্ষায় থাকেন। একটা চার বছরের শিশুও জেনে যায় ভিন্নরকম পোশাক পরিধানকারী মা বাবা’র বয়সী এই মানুষগুলোকে যে কোনো নির্দেশই দেওয়া যায়।
প্রশ্ন করতে পারেন, অস্ট্রেলিয়াতে স্কুল কর্তৃপক্ষের কি অর্থের বিনিময়ে পেশাদার পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগের সুযোগ নেই? নিশ্চয় আছে। তবে কেন তারা বাবা মা শিশুদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়? ঔপনিবেশিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন আমরা, সুশীল সমাজের বাসিন্দারা ভাবতেই পারি না– স্কুলের এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিঃসন্দেহে শিক্ষা জড়িত, যে শিক্ষা কেবল আকাশ ছোঁয়াতে শেখায়না, মাটিতেও চোখ রাখার প্রশিক্ষণ দেয় (Down to the earth বলে একটা কথা প্রচলিত আছে পশ্চিমের সমাজে)। শৈশবে আনন্দের সঙ্গে এই যে কাজের হাতেখড়ি তা–ই শিশুদের শিক্ষা দেয়– কাজের কোনো বড় ছোট নেই। শিক্ষা নিয়ে আমাদের নামজাদা বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকগণতো অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে প্রতিনিয়ত বিদেশ সফর করেন। তাঁরা কি পারবেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মানবিক ও জীবনমুখী করে তোলার ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের উদাহরণগুলো গ্রহণ করতে? এই সংস্কারে কিন্তু প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার।
ভাবতে আতংক লাগে অষ্টম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী এই বয়সে ক্ষমতার স্বাদ ও উত্তাপ ভোগ করার কায়দা শিখে ফেলেছে। এটা কি তার একার ভুল? কেবলই মায়ের ব্যর্থতা? এর জন্য আমাদের সমাজ দায়ী, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী। চতুর্দশ কি পঞ্চদশ বর্ষীয় মেয়েটির এই দাম্ভিক আচরণ আগামী দিনের নারী জাগরণের পথে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারক মা কে বদলি করে, সামজিকভাবে অপদস্থ করে এর সমাধান হবে না। প্রধান শিক্ষকের জন্য কাগুজি শাস্তির বিধান করেও কোনো কিছুর হ্রাসবৃদ্ধি হবে না। তাঁরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হবেন, না কি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ক্ষমতার মাহাত্ম জারি রাখবেন, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন। ঘুণে ধরা সমাজটাকে সারাতে হলে ভেতর থেকে শুরু করতে হবে ‘পরিচ্ছন্নতা অভিযান’। প্রশ্ন হল– আমরা তা করতে চাই কি না? আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে সাম্য, মানবিকতা ও সংবেদনশীলতার বীজ বপন করতে না পারলে শিক্ষাসনদের জন্য সকল ছোটাছুটিই অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাবে।
নিবন্ধের শুরুতে বলছিলাম শিক্ষার শক্তি, দর্শন ও সৌন্দর্যের কথা। আমাদের শিক্ষা তার কতটুকু ধারন করছে তা ভেবে দেখার এখনই সময়। নারী নির্যাতনে বাংলাদেশের অবস্থা যেমন প্রথম সারিতে, নারীর ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না– নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ গুটিকয় কিংবা অসংখ্য নারীর উঁচু পদে সমাসীন হওয়া নয়, বরং পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং শ্রেণি, বর্ণ নির্বিশেষে নারীর মর্যাদা নিশ্চিত করা। শিক্ষার হার বিশেষত নারীশিক্ষার হারের দিক থেকে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু শিক্ষিত নারীদের আচরণ বলে দেয় বড় ধরনের কোনো গলদ রয়ে গিয়েছে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা বা সনদের উদ্দেশ্য যদি হয় শোষিত ও শাসকের মাঝের সাঁকোটা পাড়ি দেওয়া, তাহলেতো আজকের শিক্ষার্থীরাও সনদ পেয়ে যাওয়ার পর শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। এমন নারীমুক্তির স্বপ্ন ক্লারা জেটকিন থেকে বেগম রোকেয়া– কেউই দেখেননি।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
 
        
