নারী শক্তি ও সাহস, নারী জননী, নারী প্রেরণার উৎস এবং নারী প্রেম ভালোবাসার প্রতীক। আবার নারী স্নেহময়ী মা, মমতাময়ী বোন, প্রেমময় প্রেয়সী, প্রিয়তমা সঙ্গিনী সর্ব পরিচয়ে পরিচিত। প্রবাদ আছে, ‘সংসার সুখের হয় নারীর গুণে’। নারী আর পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত সমৃদ্ধ বিশ্ব। যুগেযুগে নারী নিয়ে বহু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কাব্য, নাটক ও সিনেমা তৈরী হয়েছে। কোনো সময়ে নারীকে মর্যাদার আসনে, কোনো সময় অবহেলিত নারী রূপে, কোনো সময় পুরুষের ভোগের সঙ্গী আবার কোনো সময় পুরুষের অনুপ্রেরণাকারী রূপে। যে যেভাবে নারীকে উপস্থাপনা করুক না কেন নারীর নিজস্ব স্বকীয়তা ও আপন গুণে নারী আজ পৌঁছে গিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে মহাশূন্যে। তাই আজ নারী সমাজ বহুগুণে গুণান্বিত ও ক্ষমতাধর। আমার প্রিয় জন্মভূমি লাল সবুজের বাংলাদেশ আজ বলিষ্ঠ নারী নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে দুর্বার গতিতে।
প্রায়ই প্রত্যেক দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। যেভাবে পরিকল্পনা করা হোক না কেন, মোট জনসংখ্যার অর্ধেককে পিছনে রেখে একপক্ষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, কোনোভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না! যা প্রমাণ করেছে আমাদের স্বশিক্ষিত পোশাক শ্রমিক। পোশাক শিল্পের প্রাণই নারী। দেশের মোট আয়ের ৮৪ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। এই শিল্পে যুক্ত আছে ৪৫ লক্ষ শ্রমিক এর মধ্যে ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক। বিশ্বের ৮০টি দেশে পোশাক রপ্তানির শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। প্রবাস জীবনে ‘মেউড ইন বাংলাদেশ’ এক আত্ম অহংকারের নাম। আমি স্যালুট জানাই সেই সাহসী উদ্যেমী নারী শ্রমিকদের। এই প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নারীর অগ্রগতি অনেক বেশী। বাংলাদেশে শতকরা ৫৭ ভাগ নারী কর্মজীবী’। নারী শিক্ষায়, সমাজ পরিবর্তনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। নারীর এই অর্জন সম্ভব একমাত্র দৃঢ়চেতা ও অধিকার সচেতন ক্যারিশমাটিক কিছু নারী এবং নারী সহায়ক অল্প সংখ্যক পুরুষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসাবে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সেই স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে আর প্রতিষ্ঠা করেছেন নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মনে পড়ছে সেই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিখ্যাত উক্তি, ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো’। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা করা সম্ভব। তাই প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে, ‘যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত’। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, ইসরাইল বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম মাত্র ৮৫২২ বর্গ কি.মি এর মোট জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৪০ লক্ষ। ইসরাইলের জনগণ অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত এবং শিক্ষার জন্য বিশ্বের ৩য় সর্ব্বোচ্চ দেশ। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন থেকে এই পর্যন্ত মোট ১৮০ জন বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা কাজে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে নারীর সমাজ, সদ্ধর্ম ও জাতি গঠনে সর্বাত্মক চিন্তা, চেতনা, মহৎ পরিকল্পনা সর্বোপরি পুরুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের দেশেও সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দেশের যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে নারীরা ছিল রাজপথে আন্দোলনে ও নেতৃত্বে। আজ শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি সেই গৌরবগাথা সংগ্রামী, বিপ্লবী, সাহসী, ত্যাগী নারী ব্যক্তিত্বদের। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদ, কনকলতা বড়ুয়া, সরোজিনী নাইড়ু, অরুনা আসফ আলি, মাতঙ্গিনী হাজরা, বীনা দাশ। নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, ড.সুনন্দা বড়ুয়া ও প্রতিভা মুৎসুদ্দি আর মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে ড. রেনুকণা বড়ুয়া, জাহানারা ইমাম, বেগম মুশতারী শফি ও আইভি রহমানের মতো হাজারো সংগ্রামী নারী। সেই বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতায় সংগ্রামী, বিপ্লবী ও সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলি, ‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে, জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে, তিলে! জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান, মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান’।
ঠিক তদ্রুপ ধর্মবাণী ও ধর্মীয় আদর্শ নারী চরিত্রকে মহীয়ান করেছেন ধর্মযাজকগণ। মহাকারুনিক বুদ্ধ মঙ্গলসূত্রে আটত্রিশ প্রকার মঙ্গল দেশনায় বলেছেন, ‘মাতা-পিতু উপট্ঠানং’ যা বাংলায় ‘মাতা-পিতার সেবা করা’ তিনি এখানে মাতৃজাতিকে অগ্রণীতে রেখেছেন। সনাতন ধর্মে নারীকে শক্তি, সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, মাতৃত্বের প্রতীক, জগৎ জননী, জ্ঞানের ধারক, মঙ্গলময়ী ঐশ্বর্যবতী লক্ষীসহ সর্ব্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। খ্রীষ্টান ধর্মে প্রভু যিশু খ্রীষ্টের মা জননী মেরী মাতা নামে পুজনীয় ও সম্মানীয়, ইসলামে হযরত মুহাম্মদ সা. ঔরসজাত ও প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজার গর্ভজাত প্রথম কন্যা সন্তান বিবি ফাতেমা এক অনন্য মর্যাদার নাম। পিতার ধর্মপ্রচারে কন্যার ত্যাগ, আনুগত্য ও সহমর্মিতা ইসলামের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। তাই নবীজির বাণীতে বলেছেন, ‘হে ফাতিমা, আল্লাহ তোমার খুশিতে খুশী হন এবং তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হন’। এসব আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, প্রতিটি ধর্মে নারীকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তথাগত বুদ্ধের ৪৫ বৎসর ধর্ম প্রচারকালে ক্ষেমা ও উৎপলবর্ণা অগ্রশ্রাবিকা, মিগারমাতা নামে খ্যাত বিশাখা মহাউপাসিকাসহ বহু গুণী পণ্ডিত ধর্মচক্ষু লাভী ভিক্ষুণী সংঘ ও গৃহী সংঘ ছিলেন। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে শীর্ষ স্থানীয় সাতজন নারী সপ্ত ভগ্নী নামে পরিচিত। তাঁরা হলেন ক্ষেমা, উৎপলবর্ণা, পটাচারা, ভদ্রা, কিষাগৌতমী, ধর্মদিন্না ও বিশাখা। এভাবে নারীরা কালে কালে সমাজ, সদ্ধর্ম ও জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা প্রতিপালন করেছেন। বর্তমান সময়েও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অনুষ্ঠানের আগে থেকে পূর্ব প্রস্তুতি, সংঘের আহারাদি প্রস্তুত করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পরিপাটি ও নান্দনিক আবহ তৈরী করা, জ্ঞাতী পুজা এমন কি ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে দানীয় কার্যাদি সম্পাদনেও নারী সমাবেশ ব্যতীত অনুষ্ঠান শুরু করা সম্ভব হয় না, কারণ নারীর উপস্থিতি পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ/ ত্রিগুণ হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যাদের ছাড়া অনুষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি বিপুলতা হয় না তাদের কোথাও তেমন অংশগ্রহণ থাকে না শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এমন কি পঞ্চশীল প্রার্থনাও নারী কণ্ঠে খুব একটা দেখা যায় না।
মানবজাতির জীবনচক্রে সাধারণত তিনটি ভূমিকা/রোল বহমান থাকে। তা হলো: ১. উৎপাদনশীল ভূমিকা ২. পুনঃপুন উৎপাদনশীল ভূমিকা ৩. সামাজিক ভূমিকা
১. উৎপাদনশীল ভূমিকা : মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন করে নিজেকে জ্ঞানে বুদ্ধিতে মনোবলে এবং ইচ্ছাশক্তিতে উদ্দীপ্ত করে কর্মময় জীবনে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে অর্থনৈতিক মুক্তি বা আর্থিক সচ্ছলতা সাধন করে। আর এটি নারী পুরুষ সকলের আজকাল নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে পারে।
২. পুনঃপুন উৎপাদনশীল ভূমিকা : পরিবারে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আনুষঙ্গিক নিত্য কাজকর্ম যা এক কথায় বলা যায় ঘুম থেকে উঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন বারবার যেসব কার্যাদি সম্পাদন হয়, তার কোনো বিনিময় বা বেতন বা আর্থিক আয় নেই। যা এক সময় অন্ধের মতো নারীর কাজ বলে চালানো হতো। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, যদিও দুই/চার জনের রান্নার কাজ পুরুষ পারে না বা জানে না কিন্তু হাজার হাজার মানুষের পার্টির রান্না পুরুষই করে থাকে। সংসারের দুই/তিন জনের কাপড় ধোঁয়া সম্ভব না হলেও বস্তা বস্তা লন্ড্রির কাজ পুরুষ করছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কাজও পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসাবে বিভিন্ন অফিস আদালতে পুরুষই করে থাকে। তাই নারী পুরুষ উভয়ে এই কাজ করতে পারে।
৩. সামাজিক ভূমিকা : সামাজিক কাজ আদি শিক্ষক বুদ্ধের ভাষায় মুদিতা। পরের সুখে সুখী হওয়া, পরের দুঃখে দুঃখী হওয়া। যা পরিবার, সমাজ, সদ্ধর্ম, জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদেরকে পরহিতে সমর্পণ করা। ছোট শিশু কিশোরদের মেধা বিকাশে সৃজনশীল আয়োজন, গাছ লাগানো, অসুস্থ রোগীর সেবা করা, গ্রামের নানাবিধ উন্নয়নে কর্মে অংশগ্রহণ, বিহার উন্নয়নে, শিক্ষার প্রসারে, মৃত্যু ব্যক্তির সংস্কারে, যৌতুক প্রথা বন্ধে নারী পুরুষ উভয়ই করতে পারলেও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তা পুরুষের দখলে। সমাজে বসবাসকারী নারী পুরুষ সকলের আর্থিক, কায়িক ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সুন্দর ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।
নারী-পুরুষ উভয়ই মানবজাতি হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে স্থান কাল অনুযায়ী নারীর গ্রহণযোগ্যতার ভিন্নতা লক্ষ্য করা কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন কুট-কৌশলতায় নারীকে সমান সুযোগ না দিলেও নারীর নারীর শিক্ষায় অগ্রসর হয়ে আত্মসম্মানবোধ সমুজ্জ্বল রেখে নারীর সম্মুখপানে এগিয়ে যাচ্ছে। যে সমাজে নারীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয় সেই সমাজ উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করে নিঃসন্দেহে। নারী নেতৃত্বে আসলে পুরুষদের চাপ কমে যাবে দায়িত্বের সমবন্টন হবে। যে কোন উন্নয়ন কাজে নারী পুরুষের সম আর্থিক কায়িক বাচনিক অংশগ্রহণে কাজ ত্বরান্বিত হবে। তাতে পুরুষ জাতিই বেশী উপকৃত ও লাভবান হবে। সমাজে নারীদের মুক্ত চিন্তা, সচেতনতা বৃদ্ধি, আত্মনির্ভরশীল, অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশৃঙ্খলা জীবন পদ্ধতি, নেতৃত্বের গুণ, সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে অদম্য সাহসিকতা ও ইচ্ছাশক্তি সমাজ, সদ্ধর্ম ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণমুখী কাজে আত্মনিয়োগে উৎসাহী হতে হবে। অনেক সময় ক্ষমতা কেউ কাউকে দেয় না। তা অর্জন করে নিতে হয়। প্রথমত নারী সমাজে নারীদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন হওয়া বড় প্রয়োজন। নারীর গ্রহণযোগ্যতায় প্রথমে নারীদের ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। যদি একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নারী সমাজ সামাজিক উন্নয়নে উৎকর্ষতা সৃষ্টি করতে পারি আমাদের আত্মজ প্রজন্মরা অনুপ্রেরণা নিয়ে বহু বহু দূর পাড়ি দিবে। তাতে আবার জন্ম হবে মহাউপাসিকা বিশাখা আর ধর্মের নিশান বিজয়ী রাজকণ্যা সংঘমিত্রার মতো হাজারো বুদ্ধের রাজকীয় ধর্মকে রক্ষা করার নারী পৃষ্ঠপোষক। আসুন নারী পুরুেেষ মেধা-মনন-চিন্তনের সমন্বয়ে পরস্পর আন্তরিক সৌহার্দ্যে সমাজ সদ্ধর্ম জাতির সার্বিক উন্নয়নে নিবেদিত হয়ে সময়োপযোগী সুন্দর আধুনিক সমাজ বিনির্মাণ করি।
লেখক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী