নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ‘কোটা’য় থাকা না থাকা

উম্মে সালমা | শনিবার , ৩ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কোনো একটি পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যদি লুবনা সিদ্দিকা আর সাদমান আহমেদ সমান সংখ্যক নম্বর পেয়ে পাস করেন, তবে চাকরিটি সাধারণত কাকে দেওয়া হয়? আমরা সবাই জানি চাকরিটা জুটবে সাদমান আহমেদরই, কেননা লুবনা সিদ্দিকা বিয়ে করবেন, গর্ভবতী হবেন, লম্বা ছুটি নেবেন, সন্তান প্রসবের জন্য ছুটি নেবেন, সন্তানের অসুখবিসুখে ছুটি নেবেন, সন্তানের লালন পালন করতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ হারাবেন ইত্যাদি আশঙ্কা থেকে লুবনা যথেষ্ট মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও চাকরিটি পান না। নিয়োগদানকারী সংস্থা সাদমানকেই নির্বাচন করে, কারণ সাদমান চাকরির জন্য বেশি ফিট, লুবনা ততটা নয়। যুগের পর যুগ এভাবেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে সমাজ। যুগের পর যুগ এভাবেই মেধাবী নারীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেছে নারীবিরোধী সমাজ। এই সমাজ বাস্তবতায় নারীদের সামনে এগিয়ে নিতে কোটা ব্যবস্থায় নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে কি? কি ভাবছেন আইন প্রণেতারা, বিশিষ্টজনরাই বা কি ভাবছেন?

বাংলাদেশের পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে নারীরা এমনিতেই পিছিয়ে আছেন। দু’হাজার বাইশ সালে পরিচালিত সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যার একান্ন শতাংশ নারী আর ঊনপঞ্চাশ শতাংশ পুরুষ। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা যেহেতু বেশি, সেজন্য তাদেরকে এগিয়ে নিতে কাম্য সকল সুযোগসুবিধাও কী তুলনামূলকভাবে বাড়তি রাখাটা যুক্তিযুক্ত নয়?

আসুন আমরা কিছু তথ্যউপাত্ত ফিরে দেখার চেষ্টা করি। দু’হাজার আঠার সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে (নবম থেকে তেরতম গ্রেড) ছাপ্পান্ন শতাংশ নিয়োগ হতো কোটার মাধ্যমে। এর মধ্যে নারীদের জন্য ছিল দশ শতাংশ কোটা। কিন্তু পরবর্তীতে কোটা না থাকায় এসব সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন ও সফলতার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে পড়েছেন। কোটাযুক্ত বিসিএসের তুলনায় কোটামুক্ত বিসিএসে নারীরা ৩.৪৩ শতাংশ কম চাকরি পেয়েছেন। কোটা পদ্ধতি থাকা অবস্থায় যেখানে ছাব্বিশ শতাংশের ওপর নারী প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছিলেন, সেখানে কোটা তুলে দেওয়ার পর এই হার ঊনিশ শতাংশে নেমে এসেছে। কোটা না থাকায় সর্বশেষ বিসিএসে পুলিশের ক্যাডারে মাত্র চারজন নারী চাকরি পেয়েছেন। ফরেন সার্ভিসে সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দুজন নারী। এ ছাড়া পঞ্চাশটি জেলার নারীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য এই ৭ শতাংশ বরাদ্দে উপেক্ষিত হয়েছেন নারীরা।

এদিকে উদাহরণ হিসাবেই উল্লেখ করছি যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক আসন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মেয়েরা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। এতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের অংশ্রগহণ বাড়ছে। শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোটার ব্যবস্থার কারণে মেয়েরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কোটা পদ্ধতিতে নারীর অংশগ্রহণ রহিত হলে তা নারীদের সেই অগ্রযাত্রাকেই ব্যাহত করবে।

আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ আটাশএর দফা চারএ বলা হয়েছে, ‘‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনও অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এ অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।’’ অপরদিকে অনুচ্ছেদ ঊনত্রিশএর দফা তিন ()-এ বলা হয়েছে, ‘‘এ অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই নাগরিকদের যেকোনও অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা থেকে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।’’ এরই সূত্র ধরে কোটা সংস্কারের রায়ে অবশ্য আদালত বলেছেন, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।

এদিকে সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য কোটা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন। গত ২৭ জুলাই আলাদা আলাদা বিবৃতির মাধ্যমে তারা এ দাবি জানিয়েছে। নারী কোটা বাদ দেওয়ার বিষয়ে দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর (এসডিজি) একটি হলো নারীপুরুষের সমতা। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নারী কোটা অবশ্যই প্রয়োজন। শিক্ষক, অধিকারকর্মী, নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা আলাদা এক বিবৃতিতে নারীদের জন্য কোটা বহালের পক্ষে মত দিয়ে জানিয়েছেন, ‘‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোটার সুষ্ঠু বণ্টন এমনভাবে করতে হবে যেখানে নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।’’

এই লেখাটির ইতি টানব আরেকটি উদাহরণ টেনে। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা কমেছে। এবারের নির্বাচনে সরাসরি জয়ী হয়েছেন উনিশ জন নারী প্রার্থী। জাতীয় সংসদের তিনশটি আসনের মধ্যে জনগণের সরাসরি ভোটে দু’শ একাশি জন পুরুষ আইন প্রণেতা নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় সংসদে পঞ্চাশটি আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। সেখানে অবশ্য সরাসরি নির্বাচন হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সব কমিটিতে তেত্রিশ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, এ লক্ষ্য অর্জন করার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। তবে তা না হওয়ায় সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্যই নারী কোটার আবশ্যকতা রয়েছে। সেই হিসাবে আমাদের কোটা ব্যবস্থা এমনভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন যাতে করে কর্মক্ষেত্র বা সমাজে বিদ্যমান চলমান নারী পুরুষর বৈষম্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। কেবলমাত্র মেধা কোটায় চাকরি পেলেই চাকুরি ক্ষেত্রে বা সামাজিক বৈষম্য কমে যাবে এমনটি ভাবার অবকাশ নাই। যদিও তিরানব্বই শতাংশ মেধা কোটায় নারীর বৈষম্য কমবে না বাড়বে তা সময়ই বলে দিবে। ততদিন অপেক্ষার পালা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবালিকা ওমায়রা সানচেজ
পরবর্তী নিবন্ধমাইজভাণ্ডারে পবিত্র তাবার্‌রুকাতের প্রদর্শনী কক্ষ উদ্বোধন