বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের মধ্যে প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে– সমন্বিত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি। সমন্বিত উন্নয়নতত্ত্বের মূল দর্শন হচ্ছে– পরিবার ও সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো নারীর উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল দর্শন হচ্ছে– যে বিষয়গুলো নারীর অধস্ততা সৃষ্টি করে, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা। নারীর ক্ষমতায়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে– ক্ষমতার উৎস ও কাঠামোর পরিবর্তন, নারীর সুপ্ত প্রতিভা এবং সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ, তার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সিদ্ধান্তগুলোর অংশ নিয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি।
স্থানীয় সরকারের প্রায় সব কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, এটি সত্য বটে; কিন্তু ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জন কতটা সম্ভব হয়েছে– এটি এখনো আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে অনুচ্ছেদ ২৮ দফার ২–এ বলা আছে, রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী–পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৫–এ নারীর সমঅধিকার এবং তাদের কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীর জন্য যে নতুন উন্নয়নের মডেলের বিষয়ে আলোচনা চলছে, সেখানে নারীর ক্ষমতায়নসহ মূলত মোটাদাগে চারটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো– নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নারীর মালিকানা, মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি, শান্তি ও ন্যায়বিচার কিংবা ন্যায্যতা। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া দেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়– এ উপলব্ধি থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ জারি করে। ওই আদেশে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সব কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বড় বড় রাজনৈতিক দল তাদের কমিটিতে তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ওই দলগুলো ইতিবাচক কাজও করেছে।
আমাদের অনন্য এক সম্পদ ১৯৭২–এর সংবিধান। যাতে কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলা হয়নি, অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এতে নারী–পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত করা হয়েছিল। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যার ফলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই নারীরা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ১৯৯৬ সালে সরকার পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নকে যুক্ত করা হয়। ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩টি সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর ২৮ মে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯৮ সালে নারীর উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সংরক্ষিত নারী আসন ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা নারীর ক্ষমতায়ন বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বহু অভাবনীয় পদে নারী দাপটের সঙ্গে এগিয়েছে। এখন প্রয়োজন নারী উন্নয়ন নীতির সঙ্গে সাহসী ও অভিনব সামাজিক নীতির যোগসূত্র ঘটানো।
সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাও অন্যতম সহায়ক হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। নারী–পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হচ্ছে। নারী পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। পুরুষতন্ত্র ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে কুসংস্কার ও সামপ্রদায়িকতা।
চাকরির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার বাড়ছে। এক সমীক্ষায় প্রকাশ, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে, যার মধ্যে নারীর আনুপাতিক হার আগের চেয়ে কিছুটা সন্তোষজনক। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন তখনই পুরোপুরি সম্ভব হবে, যখন কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে। সেটা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পর্যায়ে হতে পারে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন মোটামুটি হলেও এর পূর্ণতা লাভের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা এখনো বিদ্যমান। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো বেশিরভাগই সামাজিক ও রাজনৈতিক। এর নিরসন না করে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন আশানুরূপ করা সম্ভব হবে না।