নারীর অধিকার- পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সোমা ধর | রবিবার , ৬ মার্চ, ২০২২ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

জানিনা কবরের ভেতরেও অভিভাবকদের বাটীতে থাকা হয় কিনা?- প্রশ্নটি করেছিলেন বাংলার নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। তাঁর প্রথম জীবনের রচনা “গৃহ”তে তিনি বলেছিলেন যে, এদেশের মেয়েরা সব অবস্থাতেই অভিভাবকদের বাড়িতে থাকে। প্রাণী জগতে সবার ঘর আছে নেই শুধু মেয়েদের। শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে ছেলের বাড়ি ,এই যেন নারীর ঠিকানা। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তবে নারীর প্রকৃত ঠিকানা কি?
১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম নারীদের অধিকার নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে সোস্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার উদ্যোগে নির্ধারিত সময় ও সমমজুরির দাবিতে ধর্মঘট পালন করেন নারী বস্ত্র শ্রমিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়। ১৯১৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীরা ভোটাধিকার পাওয়ার ফলে ৮ মার্চ সেখানে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ দিবসটি প্রথম পালন করে। তার পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৮ মার্চকে নারী অধিকার ও বিশ্ব শান্তি দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
জাতিসংঘ কর্তৃক ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে “জেন্ডার ইকুয়ালিটি টুডে ফর এ সাস্টেইনেবল টুমরো”। পৃথিবীব্যাপী নারীর অংশগ্রহণই পারবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন, দূরীকরণ ও সাড়া জাগাতে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই উন্নয়নের ধারক ও বাহক হবে। তাই নারীর সমতা আনয়ন অত্যাবশ্যকীয়।
দু’শ ত্রিশ বছর আগে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ঘোষিত হয়েছিল নারী পুরুষ সম অধিকারের দাবী। মেরি ওলস্টোনক্রাফট(১৭০৯-১৭৯৭) “ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব ওম্যান : উইথ স্ট্রিকচারস অন পলিটিক্যাল এন্ড মোরাল সাবজেক্টস” গ্রন্থে শানিত যুক্তিতে, প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করেন। দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ডঃ হুমায়ূন আজাদ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন, “ভিন্ডিকেশন নারী মুক্তি আন্দোলনের বা নারীবাদের প্রথম মহা ইশতেহার, একে মার্কিন “ডিক্লেয়ারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেস” এর সাথে তুলনা করে “নারীবাদী স্বাধীনতার ঘোষণা” ও বলা হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের পর মেরি নিন্দিত, প্রশংশিত, ধিক্কৃত, অভিনন্দিত হন। রক্ষণশীল সমাজ জানায় ধিক্কার, আর প্রগতিশীল সমাজ জানায় অভিনন্দন। তীব্র তীক্ষ্ণ এই বইটির মূল দাবী নারীও মানুষ, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, নারীর জন্ম শুধুমাত্র পুরুষের জৈবিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের নিমিত্তে হয়নি, তাকে দিতে হবে স্বাধিকার। আঠারো শতকে যখন পুরুষেরা দেশে দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব ও সংগ্রাম করে চলছিল, তখনি তেত্রিশ বছরের তরুণী মেরি নারী মুক্তির ইশতেহার ঘোষণা করেন। তাঁর এই উদ্যোগ সাথে সাথে কোনো বিপ্লব ঘটায়নি, তবে সূচনা করে এক দীর্ঘ বিপ্লবের, যা আজো অসম্পূর্ণ।
সেই থেকে এই পর্যন্ত নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন বা সম অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। দু’শ ত্রিশ বছর আগে মেরি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বা সম অধিকার প্রতিষ্ঠার যে ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন, তার অনেক কিছুই এখনও অধরা বা দূরাগত স্বপ্ন। মেরি নারীদের রঙ মেখে, সাজগোজ করে পুরুষের জন্য নিজেদের তৈরি না করে নিজেদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করতে বলেছেন।
পৃথিবী জুড়ে দেশে-দেশে এই পর্যন্ত নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং ক্ষমতায়নে নানা পদক্ষেপ এবং নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সব ধরনের বৈষম্যের অবসান, নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সহ একের পর এক বিভিন্ন সনদ জাতিসংঘে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হলেও পৃথিবী জুড়েই অধিকাংশ নারী তার ন্যূনতম মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্ছিত।
তবে একথা স্বীকার্য যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর চিন্তা-চেতনার জগতে কিছু কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীবাদী আন্দোলন, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা, শিক্ষার প্রসার এবং প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে নারীর সচেতনতা ক্রমেই বর্ধনশীল। নারী আজ অনুধাবন করতে পারে তার ক্ষমতা অপরিসীম। নারী কোনভাবেই পুরুষের চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন নয়।
নারী এবং পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। দু’য়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর পরিকাঠামোয় গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র। বিশিষ্ট দার্শনিক লেনিন এই প্রসঙ্গে বলেন, “ পুরুষের মনোবৃত্তি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল। তা পরিবর্তন করতে হলে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারী আপন সত্ত্বায় নিজেকে উন্মোচন করতে পারলেই তা সম্ভব। প্রেমের মায়াডোরে নিজেকে আবদ্ধ না করে বরং সমান সমান অধিকারের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে, সত্যিকারের ভালোবাসার মর্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই সম্পকের্র পরিবর্তন আনা সম্ভবপর।
ফরাসি শব্দ ফেমিনিজম বা বাংলায় নারীবাদ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে বোঝায়- একটি আন্দোলন যা পুরুষের মত নারীদের সমান অধিকার দাবি করে। ১৮৩৭ খ্রিঃ ফরাসি দার্শনিক ও ইউরোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে প্রথম ‘নারীবাদ’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। নারীবাদ” এবং “নারীবাদী” শব্দদুটি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ এ, যুক্তরাজ্যে ১৮৯০ এ, এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ এ। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী “নারীবাদী” শব্দের উৎপত্তিকাল ১৮৫২ এবং “নারীবাদ” শব্দের ক্ষেত্রে তা ১৮৯৫। আধুনিক পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তিনটি “তরঙ্গ”-এ বিভক্ত।
*প্রথম ঢেউ- উনিশ শতক এবং উনিশ শতকের শুরুর দিক;
*দ্বিতীয় ঢেউ -বিশ শতকের মধ্যভাগ ;
*তৃতীয় ঢেউ -বিশ শতকের শেষ এবং একুশ শতকের শুরু।
৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে নারীর ক্ষমতায়ন শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যেখানে, নারী নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তার বাস্তবায়নে, প্রভাবিত করা বা প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানে সব বাধা বিপত্তি এবং প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। নারীর ক্ষমতায়ন অর্থ পুরুষকে পেছনে ফেলে নারীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে তা নয়, বরং সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী পুরুষের সাথে সমান অংশীদারিত্ব অর্থাৎ সমতা থাকবে। এই সমতা সাধারণ শ্রমিক হতে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত কার্যকর হবে।
এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ পাঁচটি বিষয় বা স্তরকে সুনির্দিষ্ট করেছে যা নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে। ১। কল্যান, ২। সম্পদ আহরণ ও নিয়ন্ত্রণে অবাধ সুযোগ ও অধিকার, ৩। নারী জাগরণ, ৪। অংশগ্রহণ, এবং ৫। নিয়ন্ত্রণ-এ পাঁচটি বিষয়ে যদি নারীর প্রত্যক্ষ এবং কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তাহলেই জাতিসংঘের মতে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব। ১৯৯৪ সালের (৫-১৩ ) সেপ্টেম্বর মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রথমবারের মতো উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
নারীর ক্ষমতায়ন নারীর আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভবপর। আর তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। অর্থাৎ পুরুষের আলোকায়ন ব্যতীত নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের পরের বাড়ির জন্য তৈরি করার মনোভাবের যেমন পরিবর্তন দরকার, তেমনি স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত-এই ধর্মীয় কুসংস্কারের ও পরিবর্তন দরকার। “ পতি পরম গুরু”-এই প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এই ধারণাকে একমাত্র পুরুষেই পাল্টে দিতে পারে। একজন পুরুষ, পিতা, ভাই, বন্ধু, স্বামী আর পুত্র সব রূপে নারীর শক্তি হবে।
কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয়, দেশ ও সমাজ- সংস্কৃতিতে নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা চলছে অপ্রতিহতভাবে। নারীর জীবন, তাদের পরিবার ও সামগ্রিক ভাবে সমাজের ওপর এর যে মাশুল তা বিপর্যয়কর। নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বিস্তৃত মাত্রার সমস্যা। বিশ্বে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারীকে তার জীবনে পিটুনি, বলপূর্বক যৌনপীড়ন বা অন্য কোনোভাবে অপব্যবহারের শিকার হতে হচ্ছে। সচরাচর এই অপব্যবহার সেই চালায় যে নারীর পরিচিত। যা পরিব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জলজ্যান্ত উদাহরণ, যা জীবনকে বিপর্যস্ত করছে, সমাজে ভাঙন ধরাচ্ছে এবং উন্নয়নকে থামিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি হচ্ছে তা দৃশ্যমান, কিন্তু সহিংসতাও দৃশ্যমান। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বৈ কমছেনা। বলাইবাহুল্য, মহামারীতেও নারীদের ছার নেই। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সবাই এই অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব অপকমের্র দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রণিধানযোগ্য।
তাই শুরু দিয়েই শেষ করতে চাই। কেন এখনও নারীকে জিজ্ঞেস করা হয় তোমার বাবার বাড়ি কোথায়? বা স্বামীর বাড়ি কোথায়? তবে কি নারীর নিজের বাড়ি নেই? না কি থাকতে পারে না? প্রশ্নটা সকল নারীর প্রতিনিধি রূপে করলাম। আমার প্রশ্নটি হয়তো যারা স্বাবলম্বী তাদের জন্য বিচার্য নাও হতে পারে, কিন্ত সাধারণ নারী হিসেবে এই প্রশ্ন থেকেই যায়। জানিনা এর উত্তর কখনো তৈরি হবে কিনা! আসন্ন নারী দিবসের মধ্য দিয়ে যদি তার উত্তর পাওয়া যায় তারই প্রত্যাশা করি। স্বরচিত কবিতা দিয়ে ইতি টানছি—হে নারী, জীবন যুদ্ধে তোমার জয়গান অনিবার্য/যেমন দুঃখের পরে সুখের মুকুট শিরোধার্য।। হে নারী, সেই আবহমানকাল থেকে তুমি রয়েছ পিছে/ আজ সময়কে এগিয়ে নিয়ে তুমি এগিয়ে গেছ সমাজ রইল পিছে। হে নারী, অনন্ত সাধনা তোমার আর যাবেনা বৃথা / নতুন সুরে গাইবো সবাই সুখের মিলন গাঁথা।
লেখক : পি.এইচ.ডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালে প্রয়াত সদস্যদের স্মরণে সভা