নারী–পুরুষের সমতা, সম–সুযোগ, সম–মর্যাদাবোধ ও উন্নয়ন একটি দেশের তথা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক সংখ্যকই নারী। সুদীর্ঘকাল ধরে বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অসম ক্ষমতা–সম্পর্ক, অসম অধিকার ও বৈষম্যের কারণে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এ দেশের নারী জাগরণে সাড়া পড়েছিল সাধারণত শিক্ষাগ্রহণকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়া ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নারী তার অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা ও কয়েক লাখ নারীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়। বাঙালি জাতির স্বপ্ন্নদ্রষ্টা এদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল শোষণ–বঞ্চনা–বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ পথ বেয়েই আজকে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অসামান্য অবদান রাখে। যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান এবং স্বামী ও সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে আমাদের মায়েরা এক বিশাল দেশশ্রেম ও আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছেন। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই নারীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় চিন্তা করতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষিত মেনিফেস্টোতে। এতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘নারী ও পুরুষের মানবিক ও দৈহিক পার্থক্য সাপেক্ষে জ্ঞান–বুদ্ধি, প্রতিভা ও শক্তি অনুসারে জীবনে চরম উন্নতি লাভের জন্য প্রত্যেক নারীকে পূর্ণতম সুযোগ ও সুবিধা দিতে হইবে। মাতৃমঙ্গল চিকিৎসালয় এবং সেবা–সদন ও শিশু শিক্ষালয়ে (কিন্ডারগার্টেন) মা ও শিশুর খাদ্য ও স্বাস্থ্যরক্ষা করিতে হইবে। প্রত্যেক চাকুরিয়া নারীকে সন্তান প্রসবের পূর্বে ও পরে পূর্ণ বেতন মঞ্জুর করিতে হইবে।’
নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা–চেতনার আরেকটি উদাহরণ হলো পাকিস্তান জাতীয় সংসদে ২০টি মহিলা আসন সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করা। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৫৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (গণপরিষদ) অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় পাকিস্তান জাতীয় সংসদে ২০টি ‘মহিলা আসন’ সংরক্ষণ করার জন্য দাবি উত্থাপন করেন। তাছাড়া ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন।
নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়েই ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নারীদের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। ছয় দফা আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়ার আগে আমেনা বেগমকে (১৯২৫–১৯৮৯) দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনয়ন দেন। এই সময় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এই সময়ের চরম মুহূর্তে একজন নারীকে দলের নেতৃত্ব দিলে হয়তো সাধারণ মানুষ সাড়া দিবে না । বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, তেমনি নর–নারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃবৃন্দ গড়ে তোলা দরকার’। নিজের এই বক্তব্যের প্রতিফলন বঙ্গবন্ধু ঘটিয়েছিলেন দলের ভেতরে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়। তার রাজনীতির সঙ্গে প্রথম থেকেই কিছু নারী নেতৃত্বের নামও আমরা জানতে পারি। যেমন– বদরুন্নেছা আহমেদ, আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন, বেগম নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ।
১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথম রাজনীতি ও প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে উন্নয়নের মূলস্রোতধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের জন্য আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ অবারিত করে ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয় যেখানে নির্যাতিতা নারীদের অগ্রাধিকার ছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে জুডিশিয়াল সার্ভিসে নারীদের অংশগ্রহণ আইন করে বন্ধ ছিল। মেয়েরা কখনো বিচারক হতে পারতেন না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে আইন পরিবর্তন করে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর অধ্যক্ষ বদরুন্নেসা আহমেদকে শিক্ষা মন্ত্রী এবং অধ্যাপিকা নুরজাহান মুরশিদকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী অধ্যক্ষ বদরুন্নেসা আহমেদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপিকা নুরজাহান মুরশিদ দুজনেই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের মর্যাদার আসনে বসান। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে পাবনার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে যান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নজরে বিষয়টি এলে তিনি ওই নারীদের আসতে দেওয়ার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের আদেশ দেন। অনুমতি পেয়ে ওই নারীরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে আসেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা, তাদের দুর্দশার কথা, স্বাধীন দেশে নিগৃহীত এবং আশ্রয়হীন হওয়ার বিষয়টি জানান। বঙ্গবন্ধুর চোখ ভিজে যায়। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন বঙ্গবন্ধু। পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতার এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তারা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা।” মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীরা সেদিন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৭২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি নগরবাড়িতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণদানকালে পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক নির্যাতিতা মহিলাদের সমাজে যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান। তিনি অনুরোধ করে বলেন ‘নির্যাতিত মা–বোনদের সমাজে টেনে নিন। এসব নির্যাতিতা মহিলা আমাদেরই মা ও বোন, তাঁরা আমাদেরই সন্তান, তাঁদের গৃহিণীর মর্যাদা দান করে আমাদের মহত্বের ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এসব নির্যাতিতা মহিলার একমাত্র দোষ ছিল তারা বাঙালি এবং তাঁরা তাদের মাতৃভূমিকে গভীরভাবে ভালবাসে’। বঙ্গবন্ধু এসব নির্যাতিতা মহিলার মাঝ থেকে স্ত্রী পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য আবেদন জানান। (সংবাদ, সোমবার, ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নারী বা মেয়েদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্য প্রদান করেন, সেখানে নারী পুরুষ সকলের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “অন্ধ সংস্কারে আমাদের জাতির একটা অর্ধেক অংশকে আমরা ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিলাম। আপনারা ধর্মে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস রাখতে পারেন, এই স্বাধীনতায় বাংলাদেশের ভাই–বোনদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আছে।”
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নারীর সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব। ব্যক্তিজীবনেও তিনি বেগম মুজিবকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নানা পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭২, রাজধানীর আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রশংসা করে বলেন, “আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইগুলোতে তিনি নারী অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সমস্যা, দুঃখ–কষ্ট সমাধানের কথাও তিনি বলেছেন। চীন ভ্রমণের সময় কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আমার দেখা নয়াচীন‘ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন– নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কল–কারখানাতে, সৈন্য বাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। সত্য কথা বলতে গেলে, একটি জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তাহলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না। নয়াচীনে পুরুষ নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর। তিনি আরও লিখেন, ‘নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে, সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতি গঠনমূলক কাজে,তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে‘ (আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি)।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর দালাল–রাজাকারদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নারী নির্যাতিতা হয়েছিলেন। সে সময় অনেক নারী গর্ভবতী হন। ফলে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গর্ভধারণ করা মায়েদের অনেকে গর্ভপাতের আশ্রয় নেন। তারপরও ১৯৭২ জুড়ে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু এসব নারী ও যুদ্ধশিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ভারত, জাপান, জার্মান, ব্রিটেন ও রাশিয়া থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করেন। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের গ্রহণে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত ছিল না। মায়েদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না শিশুদের লালন–পালনের ব্যবস্থা করা। তাই বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিদেশে যুদ্ধ শিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। তিনি ১৯৭২ সালে Bangladesh Abandoned Children(Special Provisions) (P.O.No.124 of 1972) জারি করেন। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসা’র মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেওয়া হয়। তবে দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
লেখক : উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।