বিশ্বে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান হলেও মর্যাদাগত ভাবে নারীর অবস্থান পুরুষ এর সমকক্ষ হওয়া এখনো সুদূর পরাহত। উন্নত বিশ্বেও নারীর মর্যাদা তথৈবচ বা উল্লেখযোগ্য শতকরা হারে উচ্চ আসীনে থাকলেও এখনো পর্যন্ত আমেরিকার মতো উন্নত সমৃদ্ধ দেশে যোগ্য নারী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন
কূটকৌশল ও উদারতার দীনতায় নারী প্রেসিডেন্ট এর দেখা মেলেনি। বিশ্বে এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে যাতে নারীর মর্যাদার অবস্থানকে এগিয়ে নিতে বাধাগ্রস্ত হয়। নারী –পুরুষের মর্যাদা সমান বা সমপর্যায়ভুক্ত হতে এবং নারীর সম অধিকার আদায় এর জন্য জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার স্বীকৃতি প্রদান করে। এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের
করুণ ইতিহাস। ১৮০৭ সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা,কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এর রাস্তায় নেমেছিলেন সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা।সেই মিছিলে চলে আমেরিকার সরকারি লেটেল বাহিনীর দমন পীড়ন। এর প্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালের ২৮
ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ এবং একজন স্থপতি।
এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নারী সম্মেলনে ১৭ টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। ক্লারা জেটকিন এই সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রথম তিনি ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার
প্রস্তাব পেশ করেন। সম্মেলন শেষে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১সাল থেকে এই দিবসটি নারীদের ‘সম অধিকার দিবস’ হিসাবে পালিত হবে। দিবসটি পালনের জন্য এগিয়ে আসেন বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। অবশেষে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন এর জন্য স্বীকৃতি প্রদান
করেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সহ পৃথিবী জুড়ে ‘নারীর সম অধিকার’ আদায় এর জন্য নারী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। প্রতি বছর এই দিবসটির জন্য জাতিসংঘ একটা নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য ঠিক করে দেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে বিশ্বে নারীর মর্যাদা পুরুষের
সমপর্যায়ে এগিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে। এবার ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য হলো জেন্ডার সমতার জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন। এতসব প্রতিপাদ্য নিয়ে নারী দিবস পালন করা হলেও নারীর অধিকার আদায় এর সংগ্রাম এখনো চলছে প্রতিনিয়ত। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় আমাদের দেশের নারীদের জন্য অনেক
কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী –পুরুষের সমতা অর্জন সম্ভব হবে না। তাই প্রযুক্তিতে দক্ষতার ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ সৃষ্টির পরিবেশ অবশ্যই বাড়ানো প্রয়োজন। প্রযুক্তিতে অংশ গ্রহণের ক্ষেত্র সৃষ্টির সাথে সাথে অনলাইন সৃষ্ট সহিংসতা থেকেও সুরক্ষিত রাখার দিকে মনোযোগ প্রয়োজন হবে।নারীদেরকে প্রযুক্তিভীতি ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে। ভাসা–ভাসা জ্ঞান নিয়ে বর্তমান বিশ্বে পুরুষের সাথে সমতায় পৌঁছানো যাবেনা। প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে নারীদেরকে বাড়তি সুযোগ ও মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন।
নারীর যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন সহ নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। নারীর অধিকার আদায় এর সংগ্রাম এ পুরুষ
শাসিত সমাজব্যবস্থায় সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীরাই ক্রীড়নক হয়ে নিজেদের বোকামিতে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারে। এইখানেই নারীর উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত হয়,তবে এসব সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার অনেক তৎপর। দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে নারীর অগ্রযাত্রা
এগিয়ে নেওয়ার কাজে আগ্রহী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের নারীদের অধিকার ও মর্যাদার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
বিশ্বে এখন জাতিসংঘের স্বীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। নারীর অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে পৃথিবীর এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে দাঁড়িয়ে নারী– পুরুষ এখনও সমপর্যায়ের
মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়া যায়নি। তাই আলাদা করে নারীর অধিকার আদায় দিবস হিসেবে বিশ্বকে পালন করার প্রয়োজন পড়ছে। অগ্রসরমান জনগোষ্ঠী পুরুষ এর সমকক্ষ এবং সম মর্যাদায় নারী অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। এরজন্য দায়ী হয়তো সমাজ ব্যবস্থা। সমাজ বলতে নারী পুরুষ উভয় অংশের যোগফল, দুটো অংশের
সৃষ্টি ও একসাথে কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজের হাতেই রয়েছে সিন্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এই ক্ষমতা পুরুষকে ক্ষমতাবান করেছে আর নারীকে করেছে ক্ষমতাহীন। পুরুষ এর সফলতা ও ব্যর্থতার পিছনে নারীর ত্যাগ ও অনুপ্রেরণায় যদি দায়ী হয়,এক্ষেত্রে নারীর ত্যাগী মনোভাবই নারীকে বোকা ও ক্ষমতাহীন হওয়ার জন্য
অধিক পরিমাণে দায়ী বলে মনে হয়। নজরুলের দুটো লাইন খুব প্রাসঙ্গিক : ‘জগতের যত বড় বড় জয়,বড় বড় অভিযান /মাতা, বধূ,ভগ্নীদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান’। যদি পুরুষ এর সফলতার নেপথ্যের কান্ডারী নারীদেরকেও এখন পুরুষের সমপর্যায়ে পৌঁছাতে হয়, তবে নারীর ভাগ্য উন্নয়নের জন্য বিশ্ব প্রেক্ষাপটে
নারীদেরকে অবশ্যই আগ্রহী মনোভাব নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে সক্রিয়। এজন্য সরকারের রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। নারীদের কল্যাণে কাজ করছে স্বতন্ত্রভাবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একটা
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যও বটে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদ এর স্পীকার, বিরোধী দলীয় নেতা,বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও অধিকতর নারীর অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বিনিয়োগের বিশেষ ব্যবস্থা কার্যকর আছে। তবু্ও বাংলাদেশের নারী
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তি জ্ঞানের উন্নয়নে পিছিয়ে আছে,তাই বাংলাদেশে নারী দিবস পালন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তৈরিতে নারীদেরকে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর প্রতিপাদ্য” প্রযুক্তি জ্ঞান ও উদ্ভাবন” বিষয়ে দক্ষতা প্রদান একটি জরুরী বিষয়। কারণ প্রযুক্তি জ্ঞান ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ
এর অগ্রযাত্রা অসম্ভব। তাছাড়া সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীর প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা এবং উদ্ভাবন ক্ষমতার সক্ষমতার পরিবেশ সৃষ্টি ও সুযোগ বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে পুরো জাতির উন্নয়ন তথা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের প্রযুক্তি দক্ষতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতার সুযোগ বৃদ্ধি হোক– এ প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।