পরিবর্তন ভালো তবে পরিবর্তন–এর সাথে খাপ খাইয়ে চলা বেশ কঠিন। চেনা মানুষ কেমন বদলে যায়, আবার অচেনা মানুষ হঠাৎ আপন হয়ে ওঠে। যে মেয়েটা শীতের ভয়ে দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেও বাবা মা কিছুই বলতো না, সে যখন শ্বশুর বাড়িতে যায়, তখন সবার আগে তাকেই উঠতে হয়, নয়তো সকলে খারাপ বলে।
যে একটু জ্বর হলেই সব বাদ দিয়ে শুয়ে থাকতো, মা কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যেত, খাবার দিতো, কপালে হাত দিয়ে জানতে চাইতো কেমন আছে? সেবার কোন ত্রুটি হতো না।
সেই মেয়েটির বিয়ের পর, জ্বর গায়ে কাজ করতে হয়, বেশিক্ষণ শুয়ে থাকলে অনেকে ভাবে আসলে কাজের ফাঁকি দেয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। বরং শ্বশুর বাড়ির কারো জ্বর হলে তাকে সেবা করার জন্য তটস্থ থাকতে হয়। প্রতিমাসে মাসিকে পেটের ব্যথায় কলেজ যাওয়া থেকে সব বন্ধ করে শুয়ে থাকলেও মা বরং গরম জল করে, ওষুধ দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যেত। ডাক্তারও ডেকে আনতো মাঝে মাঝে মেয়ে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছ দেখে।
বিয়ের পর পেটের ব্যথা লুকিয়ে রাখতে হয়, নয়তো শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বলবে এই অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে মিথ্যা বলে। আগেই তো আমাদের জানানো উচিত ছিলো এসব।
নারীদের বিয়ের পর অনেক কিছু বদলে যায়। ঘর বদলায়,আপনজন বদলায়, জীবন যাপন বদলায়, চাওয়া পাওয়াও বদলে ফেলতে হয়। তখন আর কেউ ভাত বেড়ে দেয়ার লোক থাকে না, চোখের জল দেখে মন খারাপের কথা কেউ জিজ্ঞেস করে না। শরীর খারাপ লাগছে সারাদিন কাজ থেকে ছুটি দেয়ার কেউ থাকে না।
শুধু নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে যাওয়া থাকে। হাতের নখ লম্বা রেখে যত্ন করার সুযোগ থাকে না,হাতের লোশন মেখে মসৃন ত্বক রাখার সুযোগ থাকে না। থাকে না চুল, মুখ, শরীর, পা কোনো কিছুর যত্ন নেয়ার আলাদা সময়। তখন শুধু শ্বশুর বাড়ির সকলের যত্ন নেয়ার দায়িত্বই একমাত্র কাজ।
একটা মেয়ের নিজেরও যে কিছু সময় প্রয়োজন, মনের চাওয়া পূরণের ব্যাপার থাকে সেগুলো করা প্রয়োজন, নিজের যত্ন নেয়া প্রয়োজন সেটা কেউ বুঝে না।
একজন আরেকজনকে বুঝতে না পারার কারণে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। আলাদা আলাদা হয়ে একক পরিবার গড়ে উঠছে সব।
একজন নারীই পারে সব সুন্দর করে তুলতে। পরিবার, পরিজন, সংসার, আত্মীয়, সন্তান, প্রতিবেশী সব একাধারে সুন্দর করে তুলতে পারে শুধু নারী। নারীর অসাধারণ গুণ বিশ্রীকে করে তোলে সুন্দর, এলোমেলোকে করে গোছানো। নারীরা সব পারেন। তাদের ক্ষমতা অসীম।
শুধু একটু ভালোবাসা চাই, একটু যত্ন চাই, আর চাই সম্মান। এইটুকু পেলেই প্রতিটা নারী পরিবারে সকলের মাঝে ধরে রাখে সুখ।
পারভীন আপা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তার গড়ে তোলা নকশীকাঁথার গোডাউনে। এই গোডাউনে কাজ করে ১০০ জন নারী। কেউ গরীব, কেউ বিধবা, কেউ বৃদ্ধ, কেউ অনাথ, কেউ স্বামী পরিত্যক্ত, কেউ সব থেকেও অসহায় এরকম নারীরা।
পারভীন আপার অনেক টাকা। বাপের বাড়ির সম্পত্তি পেয়েছে অনেক, স্বামীর ব্যবসায়ের টাকাও প্রচুর আছে উনার শুধু নাই পরিবারে সম্মান। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার মতন নিজেকে তৈরি করে আলাদা থাকে, ছেলেমেয়েরা বাবার আচরণ ছোটকাল থেকে দেখে তারাও মাকে যে সম্মান করতে হয় সেটা শেখেনি, পারভীন আপার স্বামীও ব্যবসা নিয়ে এখানে ওখানে চলে যান, বৌয়ের দিকে তেমন কোনো নজরই দেন না। কিছু বললেই কথা একটাই মাস শেষে প্রচুর টাকা দিই আমি তোমাকে। আর কি লাগে?
পারভীন আপা বুঝলেন সংসারে উনার কোন মূল্যায়ন নেই তাই নিজের পরিচয় ও সেবামূলক কাজ করতে নকশীকাঁথা সেলাই ও বিক্রির এই উদ্যোগ নেন তিনি। বাবার সম্পত্তি থেকে পাওয়া দোকানটাকে বড় করে একটা গোডাউন করে পাশে আরেকটা দোকান কিনে দুঃখী মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। প্রথমে পাঁচজন মেয়ে ছিলো। এখন একশ,তবে তিনি দেখলেন মেয়েরা অনেক ভালো কাজ করে। নকশীকাঁথায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে।
একটা বড় মার্কেট এ এখন তিনি নকশীকাঁথা সাপ্লাই দেন সেখানে পারভীন আপাকে সদস্য করেছেন ব্যবসায়ীরা আগামীকাল সেখানে উনাকে বক্তব্য দিতে হবে বলেছে তাই সকল নারীকর্মীর সামনে একটু নিজের কথাগুলো বলে প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন।
সকলে খুব উৎসাহিত করলো ওরা সবাই আপা বলে ডাকে ভালো লাগে পারভীন বানুর। বয়সটাকে কম মনে হয়, আর বিভিন্ন নারীদের সাথে থেকে অনেকরকম ঘরের চিত্র পাওয়া যায়, নিজের দুঃখ থেকেও যে বেশি দুঃখ মানুষের সেটা বুঝতে পারে, আবার মেয়েদের অনেক গুণ বের হয়ে আসে কাজের মধ্য দিয়ে।
পারভীন বানু পরেরদিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে উঠে চোখ আটকে গেলো সামনের সারির একটা চেয়ারের দিকে। কারণ ঔ চেয়ারে বসে আছে পারভীন বানুর স্বামী। প্রথমে একটু গলা ধরে আসতে চাইলো, বুকটা কেমন ধুকপুক করতে লাগলো পরে নিজের মনে নিজে সাহস সঞ্চয় করে বক্তৃতা দিতে শুরু করলো।
অনেকগুলো ব্যবসায়িক কথা বললো পারভীন আপা, অনেক উঠানামা থাকে ব্যবসায়, ভেঙে পরলে চলবে না। ইচ্ছা, সৎসাহস ও উদ্যোমী হয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে যখন বক্তৃতা শেষ করলেন তখনই তালিতে মুখরিত হলো চতুর্দিকে।
সবাই খুব প্রশংসা করলো, অনেকের সাথে পরিচয় হলো খুব ভালো সময় কাটলো।
বাসায় ফেরার দু’ঘন্টা পর স্বামীও ফিরে আসলো। এসেই চিৎকার শুরু করলো তুমি যে ব্যবসা করছো আমাকে তো জানাওনি?
কি ব্যপার? আজকে যে তুমি আমার ব্যবসার জায়গায় গিয়ে ভাষণ দিবে আমাকে কেন বলোনি?তোমার এতদূর সাহস কি করে হলো? উত্তর দাও!
একসাথে এত জোরে এত প্রশ্ন করবে পারভীন বানু বুঝতে পারেনি তবে আজকে যে একটা কিছু ঘটবে তা বক্তৃতা দেয়ার পর থেকে বুঝতে পেরেছে। আর ওখানে একবারও সামনে আসেনি সেটাও খেয়াল করেছে।
আমার মাথা কাটা গেলো, আমার সব সম্মান নষ্ট হয়ে গেলো।
তোমার স্ত্রী হিসেবে তো কেউ আমাকে চিনে না, সবাই আমাকে আমার পরিচয়ে চিনে তাহলে তোমার সম্মান গেলো কি করে? পারভীন বানু বললো।
তুমি কি করে বুঝবে আমার সম্মান কতটা নষ্ট হলো?
আর তোমাকে কে এসব কাজ করতে বলেছে আমাকে না জানিয়ে? আমি থাকিনা ভেতরে ভেতরে এসব করো তুমি? ছেলেমেয়েদের ডেকে সব বলবো, আমার বাসায় এসব চলবে না বললেন পারভীন বানুর স্বামী শওকত সাহেব।
ঠিক আছে আমি চলে যাব। আর তুমি তো থাকই না তাহলে জানবে কি করে? আজকে তো শুনলাম তোমার নাকি কোথায় কোথায় রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে তাহলে আমার খবর নেয়ার সময় কই তোমার? বললেন পারভীন বানু।
কি ! তোকে আমি কি করতে পারি জানিস? শওকত সাহেব বললেন।
পারভীন বানু বললেন জানি, তার জন্য আসার সময় একটা থানাতে জি ডি করে আসছি যাতে আজ রাতে কিছু হলে তোমাকেই গ্রেপ্তার করে।
এতদূর!!
তোর সাহস তো বেশি বেড়েছে, এগুলো কে শিখিয়েছে? তোকে আমি আর রাখব না। বের হয়ে যা তুই আমার বাড়ি থেকে শওকত সাহেব চিৎকার করে উঠলেন।
ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, যেকোন সময় যে আমাকে বের হয়ে যেতে হবে তা আমি জানতাম তাই আগেই বাবার দেয়া ফ্ল্যাটগুলোর মধ্যে একটা নিজের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। ভালো থেকো তুমি বলে পারভীন বানু ঘর থেকে বের হলো।
পারভীন যখন বের হয় তখন মাঝরাত, এত রাতে সাধারণত কোন গাড়ি পাওয়া যায় না, তবু বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা রিঙা পেলো। ঠিকানা বললে যেতে চাইলো না, তখন দ্বিগুণ টাকার কথা বলে রাজি করানো হলো, সেই সাথে বিপদে পরে যেতে হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে হলো।
যখন প্রথম কাজটা হাতে নিয়েছে তখনই পারভীন স্বামীকে বলার কথা ঠিক করে রেখেছিলো, কিন্তু কাকে বলবে? স্বামী আসে সপ্তাহ, পনেরো দিন পর পর। আর এসে কোনো কথা শুনতে চায় না। মেজাজ থাকে বেশ খিটখিটে, তাই আর বলার সুযোগ হয়নি। আর এই ব্যবসাতে যে এত তাড়াতাড়ি এত মানুষ ও এত খ্যাতি লাভ করবে সেটা তো পারভীন বানুর নিজেরও জানা ছিলো না।
আর এছাড়াও তার স্বামীও যে ঐ মার্কেটে ব্যবসা করে সেটা তো সে জানতো না। কোনদিন কোন কথাই তো বলে না নতুন কি কি করছে?
নিজের ফ্ল্যাটে উঠে শান্তি লাগছে পারভীন বানুর। অনেক দিন পর দেরিতে ঘুম থেকে উঠলো। তারপর নিজের মতো করে আস্তে আস্তে সব খাওয়া হলো। গোছানোর কোনো তাড়া নেই এক অন্যরকম ভালো লাগায় মন ভরে উঠলো। আজ আব্বা, আম্মার কবরে যাব কিছু দান করবো তারপর নিজের নকশীকাঁথার দোকানে বসবো।
বেশ কিছুদিন পর নকশীকাঁথার পাশাপাশি নিজে ব্যাগ কেটে ব্যাগ বানানোর প্রস্তুতি নিলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটাও বেশ সুনাম অর্জন করলো ও প্রচুর বিক্রি শুরু হয়ে গেলো।
মাঝে মাঝেই একটা দুইটা কল আসে কিন্তু পারভীন বানু আর ধরে না।
বাঁচার জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ, সুন্দর মানসিকতা, ও একটু সম্মান এটাই যথেষ্ট তাই আর ফিরে তাকানোর দরকার নেই। শওকত সাহেব বুঝলেন তিনি সত্যিই ভুল করেছেন।
পারভীন এখন স্বাধীন তাই বেশ নিজের মতো করে সময় পার করেন,ব্যবসাতে বসেন, মেয়েদের কাজ দেখেন। একদিন দোকানে হাজির হলো শওকত সাহেব। মাফ চাইলো। এখন তিনি বেশ অসুস্থ তাই পারভীন বানুকে অনুরোধ করতে লাগলেন বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য।
পারভীন বানু শুধু বললেন মেয়েদের শুধু সংসারে লাগে সম্মান, শান্তি ও একটু যত্ন। আমি আজ সব পেয়েছি আমার এখানে কাজ করা সকল মেয়েদের থেকে, তাই আজ আর পেছনে তাকাতে বা ফিরে যেতে পারবো না।
জীবন খুব ছোট, এই ছোট্ট জীবনে ভালোবাসা, যত্ন, সম্মান প্রাপ্তি হোক সকল নারীদের।