ইদানীং নারীরা আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশে একের পর এক নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের ঘটনার পর শ্বাসরোধ করে হত্যা বা খুন অহরহ হচ্ছে। মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। কোনো না কোনো অজুহাতে মেয়েদের নাজেহাল হতে হয়। প্রতিবাদ করলে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। গত কয়েকদিনের ঘটনার চিত্র দেখলে তা স্পষ্ট হয়। নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। প্রশাসনের সব স্তরে নারী থাকা সত্ত্বেও দেশের পরিস্থিতি এমন ভয়ানক হয়ে উঠছে।
দুই নারীর ধূমপান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অপরাধের কথা বললেন। সেখানে দুই নারীর ধূমপানকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করলেন ঠিকই, কিন্তু একবারও বলননি হামলাও একটি অপরাধ। অর্থাৎ, সমর্থন জানালেন রিংকুকে। যেন রিংকুর মত অপরাধকারীরা অপরাধী নয়। তারা আইনের ঊর্ধ্বে। যেমনটা দেখেছিলাম ওড়না পরার ব্যাপারেও। যিনি অপরাধী তাকে ফুলের মালা দিয়ে বের করে নিয়ে এলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ে শার্ট–প্যান্ট পরা নারীকে নিয়ে যদি কোন প্রশ্ন না ওঠে, এখন কেন ওড়না গায়ে থাকা না থাকা নিয়ে হেনস্তার শিকার হতে হবে? বরের সাথে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া নারীকে ধর্ষণের পর তার জিহ্বা কেটে নেওয়া, বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ছোট্ট মেয়েটার ধর্ষিতা হওয়ার কথা আপনারা সকলেই জানেন, তাকে কি বীৎভসভাবে ধর্ষণ করেছে। অথচ সে শিশুটি নারী হয়ে উঠেনি তখনও। স্কুলে কোচিংয়ের কথা বলে যে শিক্ষক মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে, সে এখনও প্রকাশ্যে ঘুরছে।
সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনা ৯ মার্চ বাবা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণের ঘটনা। মা গার্মেন্টস কর্মী। দিনেরবেলায় থাকে না। সে সুযোগটা ১০ বছর মেয়েটার ওপর নিলো বাবা। দিনেরবেলায়ও নারী, শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয় আমাদের।
ফেব্রুয়ারিতেই শুধু ১৮৯ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, ধর্ষণ ৫০। এর মধ্য সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১জন নারী। এছাড়া বিভিন্ন কারণে ১০ জন কন্যাসহ হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে। এসব তথ্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাঠানো এক প্রতিবেদনে উঠে আসে। যা ১৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে।
এছাড়াও ১৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। ১৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আট কন্যা অপহরণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ থামছে না। ফেব্রুয়ারিতেই শুধু মামলা হয়েছে দিনে ১২টি। অথচ সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
পথে, মাঠে, ঘরে নারীর প্রতি বিদ্বেষ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হেনাস্তার ঘটনা বরাবরই হয়ে আসছে। এসব ঘটনা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ফলে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম শিকার বার–বার হচ্ছেন নারীরা। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
নারী দিবস এলেই নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের কথা বেশি বেশি আলোচিত হয় বিভিন্ন সভা– সেমিনার ও দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচিগুলোতে। তবুও কেন জানি এটার কোন সুরাহা হচ্ছে না। জীবনে চলার পথে নারীর ভূমিকা অপরিসীম, যা আমরা নিজ জায়গা থেকে অনুধাবন করছি। আমাদের সমাজে নারীর মর্যাদার কথা প্রতিনিয়ত শোনা যায়। কবি নজরুল ইসলাম বহু আগে লিখেছিলেন, ‘বিশ্বে যা–কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
আমাদের দেশেও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে কাগজে–কলমে। সরকারি–বেসরকারি দপ্তরে পুরুষদের সঙ্গে নারীরা সমানতালে কাজ করছেন। শিক্ষাদীক্ষায়ও ব্যাপকভাবে এগিয়ে রয়েছেন তারা। তবে নারীরা সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও ঘরে–বাইরে, যানবাহনে, শিক্ষালয়ে, কর্মস্থলে তাদের নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি এখনও। একজন নারীর শৈশব–কৈশোর পার করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। নারীর চলতি পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক নানা বৈষম্য। শিক্ষাজীবনে যৌন হয়রানি, কর্মস্থলে সহকর্মীদের অশ্লীল দৃষ্টিভঙ্গি, বিবাহিত জীবনে যৌতুকের দায়ে নির্যাতনের শিকার এবং পারিবারিক জীবনে নীরবে নানাভাবে অমর্যাদায় ভোগেন।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতন নিয়ে আইন আছে। কিন্তু আইন থাকলেও তাতে নিপীড়নের মাত্রা কমছে না। সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী নির্যাতনের খবর প্রায়ই দেখতে পাই। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের আইন আছে বটে কিন্তু বিচারব্যবস্থা দুর্বল।
বিশ্বব্যাংকের ‘নারী, ব্যবসা ও আইন ২০২৪’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, অবাধ চলাচল, কর্মক্ষেত্র, মজুরি, ব্যবসায় উদ্যোগ, সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর তুলনায় বাস্তব কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকার আরও কম। কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র আইনি অধিকার ভোগ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তান বাদে বাকি সবার নিচে।
জাতিসংঘের মহিলা দপ্তর ইউএন ওম্যানের প্রধান চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল বাচেলেট, সারা বিশ্বে নারীদের অধিকার রক্ষা এবং আদায়ে একশো দিনের অ্যাকশান প্ল্যান হাতে নিয়েছেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্বের নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বাচেলেট।
এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘মহিলাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কর্মজীবী মহিলা, বিচক্ষণ মহিলা হলো যে কোন দেশের, যে কোন সমাজের অমূল্য সম্পদ। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হল সব ধরনের বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে এই অমূল্য সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।’ তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দেন উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান–গরিমার সমতাকে। এক্ষেত্রে পাঁচটি বিশেষ নীতির কথাও বলেন তিনি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করা, নারী–পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী কী হচ্ছে সে বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে নারীদের অবগত করা।
আমরা এমন বহু চিত্র দেখি যেখানে সরকারি চাকরিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব, ব্যবসায় নারীর প্রবেশগম্যতা যে কতটা কম, তা আমরা সবাই অনুভব করি। খেলাধুলার ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য পুরুষদের সমতুল্য প্রায়। অথচ সেক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ অনেক কম। তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের শোষণ বেশি, সেখানেও পুরুষের তুলনায় নারীদের বেতন খুবই কম, কোনো সুরক্ষাবলয় নেই বললেই চলে।
সকল ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন গৃহিত হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক রাষ্ট্রপক্ষের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কনভেনশনটি কার্যকারিতা লাভ করে। বর্তমানে এই কনভেনশন অনুমোদনকারী রাষ্ট্রপক্ষের সংখ্যা ১৬১।
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন সবচেয়ে ব্যাপক ও আইনগতভাবে অবশ্য পালনীয় নারীর মানবাধিকার। নারীর আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস হিসেবে অভিহিত এই কনভেনশন বৈষম্যের অবসানে জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি এজেন্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
কনভেনশনের শর্তানুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষসমূহের প্রতি নারীর মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে নারীর শোষণ রোধ নিশ্চিত করা; রাজনৈতিক ও লোকজীবনে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান; জাতীয়তা অর্জন, পরিবর্তন বা বহাল রাখার সমান অধিকার নিশ্চিত করা; শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্যান্য ধারায় গ্রামীণ নারীর সমস্যা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং বিবাহ ও পারিবারিক জীবনে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান সংক্রান্ত বিষয়গুলো রয়েছে। কনভেনশনে নারীর নিজ নিজ দেশে রাজনৈতিক ও লোকজীবনে অংশগ্রহণ এবং সরকারের সকল পর্যায়ে সকল কাজ করার অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে।
নারী অধিকার বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বোঝানো হয়। অতএব যদি কারো ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করা হয়, অথবা তার কর্তব্যে বাধা দান বা তার সামর্থ্যের অধিক কোন দায়িত্ব–কর্তব্য তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, কিংবা তার অবদান সমূহের সঠিক মূল্যায়ন না করা হয়, তাহ’লে তার অধিকার ও মর্যাদা খর্ব করা হবে এবং তার প্রতি অবিচার করা হবে। আর যখন তার অধিকারসমূহ স্বীকার করা হয়, তার সামর্থ্য অনুসারে তাকে দায়িত্ব–কর্তব্য আদায় করার পূর্ণ সুযোগ দান করা হয় এবং সামাজিক জীবনে তার অবদান সমূহের মূল্যায়ন করা হয়, তখন তার উপযুক্ত মর্যাদা দান করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
জনগণ সরকারের কাছে প্রত্যাশা করে, সরকার তার দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করবে। জনগণের করের টাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলে। অথচ এই ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে সেভাবে তৎপর হতে দেখা যায় না। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়নের সব ঘটনা প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে আসে না। বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বা আগে থেকে ঘটেছে এমন অজুহাত শুনি। দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই রাষ্ট্রের। মাগুরার ঘটনার পর মধ্যরাতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকার অবস্থান না নিলে জনগণ অবস্থান নিবে এটা দেখিয়েছে। তারপরে সরকারের টনক নড়লো। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সদিচ্ছা সরকারের আছে বলে আমার বিশ্বাস। আমার একটা দাবি সরকারের কাছে, প্রকাশ্যে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা, বিদ্রুপ, কটুক্তি বন্ধ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীর প্রতি সহানুভূতি নয়, সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যে জাতি নারীদের সম্মান করতে পারে না, সে জাতির উন্নতি অসম্ভব। তাঁকে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হলে বিশ্ব আরও এগিয়ে যাবে। নারীদের জন্য নিরাপদ একটি সমাজ গঠন করতে হবে। যেদিন নারী স্বাচ্ছন্দ্যে একা একা পথে হেঁটে বেড়াতে পারবে, সেদিন হবে নারীর অধিকার আদায়।