বাবা–মা মরা ছেলে কমল, মামার বাড়িতেই তার বেড়ে উঠা।মামা ছিল নিঃসন্তান,মামা–মামি নিজের সন্তানের মতো কমলকে লালন পালন করেছে। কখনো অশনি ছায়া গায়ে লাগতে দেয়নি। কমল ভীষণ দুষ্টু ছেলে। প্রতিদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলা করতো। নারকেল পাতার বাঁশি তৈরিতে বেশ পটু।পড়ালেখায় যদিও শ্রেনির একদম শেষ রোল তার দখলে থাকে। কিন্তু বাঁশি তৈরির কাজে সে সবার উপরে উস্তাদও বলা যায়।কমল কলা বাদুরের মতো রাত–বিরাতে এ–গাছের আম,ওই গাছের কলা এরকম নানান ফলফলাদি চুরি করে খেয়ে আসতো। কমলের কর্মকাণ্ডে গ্রামের মানুষ অসন্তুষ্ট। প্রতিদিন মামার কাছে একটার পর একটা নালিশ আসে। মামা ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের বিদায় করে দিতো।কিন্তু তাকে কিছু বলতে পারতো না।বাবা–মা মরা ছেলেটাকে বেশি কিছু বলতে গেলে আবার কষ্ট পাবে।এই ভেবে মামা বলতে গিয়েও কিছু বলে না। দিন দিন কমলের দুষ্টুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। স্কুল থেকে একের পর এক নোটিশ আসছে। কমল প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক, এবং বার্ষিক পরীক্ষায়, ছয় বিষয়ের মধ্যে একটা বিষয়েও তেত্রিশ পেয়ে পাস করতে পারেনি। তা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।বরং দিব্যি দুষ্টুমি করে যাচ্ছে।এক সময় স্কুল থেকে তাকে বের করে দেয়। তার খারাপ রেজাল্টের জন্য স্কুলের দীর্ঘ দিনের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এই দোষের দায়ে প্রধান শিক্ষক টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে।কমলের চেয়ে মামা–মামি ভীষণ চিন্তিত, মেঘলা আকাশের মতো মন ভারি করে বসে আছ তারা। কমলের আর স্কুলে যেতে হবে না।এই ভেবে খুশিতে আত্মহারা। এভাবে তার এক সপ্তাহ কেটে যায়। অন্যদিনের মতো আজও সে খেলার উদ্দেশ্যে মাঠে যায়। আজ মাঠের পরিবেশ মনমরা, ঘুঘু পাখি কচি পাতার আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে ডেকে উঠে।কাকের দল ছড়িয়ে থাকা ভাতের দানা পেয়েও মুখ ফিরিয়ে আছে।সূর্য শরতের সাদা মেঘের ভাঁজে লুকোচুরি খেলছে।
আজ কমলের মন ভীষণ খারাপ,আগে কখনো তাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখা যায়নি। দুষ্টু ছেলেটা হঠাৎ করে বাতাস বিহীন বেলুনের মতো চুপসে গেলো। তার অশ্রুসিক্ত মুখ থেকে মামার বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো।মামা কমলের কাছে গিয়ে বলল,’ আজ আমার কমল বাবার মন খারাপ কেন? মনে হয় আকাশের সাথে মেঘের দ্বন্দ্ব চলছে! কী ব্যাপার বাপজান? মামি কিছু বলেছে? সে কোনো কথা বলে না। কমলের মন খারাপ কিসে তা আর ওইদিন জানা গেলো না।কমল রাতের খাবার খায়নি বলে মামা–মামিও না খেয়ে শুয়ে পড়েছে।
সে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে,আজ আমাকে ওরা খেলায় নিলো না কেন? মনে হয় আমি দেরি করে যাওয়ায় তারা নেয়নি,এই যদি হয় তাহলে আমি আগামীকাল সবার আগে গিয়ে মাঠে বসে থাকব। তখন দেখবো আমাকে খেলায় কিভাবে না নেয়।সে বিছানায় এপাশ–ওপাশ করছে।আগামীকাল খেলতে যাবে এই আনন্দে ঘুম আসছে না। তার কাছে আজ রাতটা দীর্ঘ লাগছে। বিছানা থেকে উঠে বসল।টেবিলের সামনে গেল। আগে কখনো বই খুলে দেখেনি এই জন্য এখনো নতুন বইয়ের মত ঘ্রাণ করছে। মনোযোগ সহকারে কী সব পড়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। তার বই পড়তে আজ ভীষণ মন টানছে।বেশ কয়েক ঘন্টা পড়ার পরে কমল ঘুমিয়ে পড়ে।।
ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ, গোয়ালঘরের লালু গাভীর দু‘দিনের বাছুরের হাম্বা হাম্বা ডাক,বনমোরগের চেঁচামেচিতে কমলের ঘুম ভাঙল। বাম হাত দিয়ে সে জানলার একটা অংশ খুলে দিল। সকালের স্নিগ্ধ রোদ মুখে চমক কাটল।সে বেশ খুশি মনে ঘুম থেকে উঠল। সকালের নাশতা না খেয়ে খেলার মাঠে চলে গেলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে আসল,তবুও কেউ গেল না খেলতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসল তবুও কেউ খেলতে যায়নি। এভাবে এক সময় রাত নেমে আসে,তবুও কেউ যায়নি খেলতে। সে মন খারাপ করে বাড়িতে চলে আসে।কমলের মন অস্থির হয়ে আছে। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পায়। সে আবার স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করতে চায়। মামা, প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করলে, সে মুখের উপর না সূচক বাক্য বলে দেয়।এমন ছাত্র তাদের স্কুলে দরকার পড়বে না।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় কমলের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসল। ধীরে ধীরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে,দিন দিন তার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। ঘরবন্দি জীবন থেকে সে মুক্তি চায়।নারকেল পাতার বাঁশি তৈরি করে রুমের চারদিক সাজিয়ে রেখেছে।কমলের ছেলেবেলার বন্ধুদের জন্য। অতপর কেউ আসল না তার তৈরি নারকেল পাতার বাঁশি নিতে। সে মামা–মামিকে পাশে ডাকল। মামা ছোটবেলা কমলকে যেভাবে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, ঠিক তেমনি ভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।সে মুচকি হেসে বলে,’ মামা, আমি যদি যাই হারিয়ে অচেনা ওই পথটি ধরে।ইমলি পাতার গভীর বনে খুঁজবে বুঝি খুব।মামা বলল,’ এসব কী বলছিস পাগল ছেলে। আমি থাকতে তুই কোথাও যেতে পারবি না। এখন চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়তো।
কমল ছোটবেলার মতো করে মামা–মামির গালে চুম দিলো। মামি আলতো করে হাতে–পায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। কমল মামার কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর কূলে ঢলে পড়ল।মামা অনুভব করল কেউ তার বুকে একনাগাড়ে তীর বিঁধে ক্ষতবিক্ষত করছে। মামা–মামি দু‘জনই তার মৃত দেহ জড়িয়ে কান্না করছে।কমলকে মায়ের পাশে সমাধি দেওয়া হয়।মামা কমলের মৃত্যুর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, গভীর রাতে কমল, কমল বলে আঁতকে ওঠে। মামা নারকেল পাতার বাঁশির মধ্যে কমলকে খুঁজে পায়।কমলের নারকেল পাতার বাঁশিগুলো মামা খুব যত্নে রেখে দিয়েছে।যখন তার কথা মনে পড়ে, তখন নারকেল পাতার বাঁশিগুলো বের করে চোখের পানি ঝরায়।