সম্মান, স্বীকৃতি, ঐশ্বর্য–এক জীবনে সব পেয়েছিলেন কবরী। সাফল্য বোধহয় মানুষের সব দুঃখ–কষ্ট মুছে দিতে পারে না। আর সেজন্যই যা কিছু অপ্রাপ্তিও তা–ও কবরীকে আজীবন তাড়িত করেছে। সম্ভব হলে ঈশ্বরের কাছে ফিরিঙ্গি বাজারে ফেলে আসা কিশোরী জীবনটা ফেরত চাইতেন তিনি। ফ্রক পরা সেই ১৩ বছর বয়সে সংসারের প্রয়োজনে বলি দিতে হয়েছিল তাঁর মিনা পাল নাম ও পরিচয়।
ঠোঁটের কোণের ভুবনমোহিনী হাসি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘সুতরাং’ এর সেটে। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত সেই প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমেই পেয়েছিলেন বিপুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু তার বিনিময়ে হারাতে হয়েছিল অনেককিছু। বিয়ে করতে হয়েছিল চিত্ত চৌধুরীকে। পেশায় প্রযোজক ও ব্যবসায়ী চিত্ত বাবু বয়সে কবরীর বাবার সমান প্রায়, আগের দুই ঘরে দুটি সন্তানও রয়েছে। বিপুল জনপ্রিয়তার জীবন থেকে কবরী সোজা এসে পড়েছিল সংসারের নোংরা–পাকে। শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হওয়া সেই সংসার মোটেই সুখের ছিলো না।
এক সন্তান নিয়ে ১৪ বছরেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কিশোরী কবরী। সেসময় তার সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন জহির রায়হান। ‘বাহানা’ সিনেমা–তে কাজ করার সময় পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ঘর ছাড়েন তাঁরা৷ কিন্তু হিন্দু বিবাহ রীতি এবং সমাজের গড়ে দেয়া বিধিনিষেধ কবরীকে আবারও ফিরিয়ে আনে চিত্ত বাবুর সংসারে। এবার পূর্বের চেয়ে আরও যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন! আবারও দীর্ঘ গৃহকোণ!
তবে অসহায় কবরীর ভাগ্য সহায় হয়েছিল। অর্থ প্রাপ্তির লোভে আবারও অভিনয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন তার স্বামী। সেই ‘হীরামন’ ছবি দিয়ে পাল্টে যায় কবরীর জীবন। এরপর ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’র মতো একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিতে থাকেন তিনি। ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখন জুটি বাঁধেন রাজ্জাকের সাথে।
তাদের জুটিকে দর্শক সমাদরে গ্রহণ করেছিল। বছরে ১৩–১৪টা সিনেমা মুক্তি পেতে শুরু করে সেসময়, সবই ব্যবসাসফল। অনস্ক্রিনের সেই রসায়ন গড়িয়েছিল অফস্ক্রিনেও। সংসার জীবনে অসুখী কবরী, রাজ্জাকের আন্তরিকতা আর যত্নে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবরী সেই সম্পর্কের নাম দিয়েছিল ‘লাভ এণ্ড হেইট রিলেশনশিপ’– বিস্তারে বললে বন্ধুর চেয়ে বেশি, প্রেমের চেয়ে কম। তখন কবরী চাইতেন তাঁর সব ছবির নায়ক হোক রাজ্জাক। তবে সেই জুটিও বেশিদিন টেকেনি। লাভের চেয়ে হেইট–এর পরিমাণ বেশি হয়ে গিয়েছিল।
আর একবার বন্ধু হারানোর তীব্র কষ্ট পান কবরী। চলতে থাকে সেই একঘেয়ে জীবন। সারা বাংলায় আলো ছড়ানো নায়িকার জীবন ছিলো অন্ধকারের। প্রায় ১৪ বছর চিত্তবাবুর নির্যাতনের সংসার করার পর তাঁর বয়স যখন ২৭ তখন জীবনে এসেছিলেন শফিউদ্দিন সারোয়ার। আবারও মুগ্ধ হয়েছিলেন কবরী, তবে ব্যক্তিত্বের চেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল সারোয়ারের পরিবার। রাজনীতি এবং সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এই পরিবারের প্রতি মুগ্ধতায় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন কবরী। বিয়ে করে ৩০ বছর সংসারও করেছিলেন। একই সাথে চলছিল অভিনয়, প্রযোজনা। নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন সেই ৩০ বছরের মধ্যে ২০ বছর অন্তত সুখের ছিলো।
যুগল জীবনে তিক্ততা আসে কবরীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে। নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা আসনের মনোনয়ন পত্র পূরণের সময়ে হাতে আসে সারোয়ারের ডির্ভোস লেটার। শিল্প–সংস্কৃতি আর রাজনীতির ধারক–বাহক পরিবারটি ব্যক্তি কবরীর জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিলেন। আবার কবরীর বন্ধুহীন বন্ধুর পথ চলা শুরু।
যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে–শুধু নিজের জীবন ছাড়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থান করেছিলেন। সেসময় একজন সফল সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। সংসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনে বোম্বের থার্ডক্লাস ছবিতে অভিনয় করেছেন। স্বাধীন দেশে ফিল্ম সোসাইটির উন্নয়নে নিয়েছিলেন একাধিক পদক্ষেপ। পেশাগত জীবনে তাঁর একটাই খেদ– সত্যজিৎ এর নায়িকা হওয়া হয়নি। প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির হিসাব মিলিয়ে ঢিমেতালে চলছিল জীবন। তারপর করোনায় টেনে নিলো কবরীকে।
যত সহজে বলে ফেলা যায়, জীবন মোটেও তত সহজ নয়। নিয়তির নিগ্রহের শিকার ছিলেন কবরী। বহুবর্ণে বিচ্ছুরিত তাঁর জীবন। লেখকের ভাষায়–সবমিলিয়ে নায়িকার জীবনই যেন এক সিনেমার চিত্রনাট্য। সত্যিই তাই!
গড়পড়তা বাঙালিরা কবরীর জীবন সম্বন্ধে যতটুকু জানে, আমিও ততটুকু জানতাম। অন্যদিকে ‘নার্গিস’ আর ‘আশালতা’র মাধ্যমে লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখার সাথে পরিচয় ছিল। তাই বইটা পড়া শুরু করার আগে থেকেই জানতাম কবরীর সাথে বেদনামধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই বলে এত! লেখকের সরল এবং অনায়াস বর্ণনা বুকের কাছে জলের মতো আটকে থাকে। কবরী–তো শুধু একজন শিল্পী নন, বলতে গেলে বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি। আর সেজন্যই বইটা পড়তে পড়তে চলচ্চিত্র জগতের অনেকের জীবনের আলো আঁধার পাড়ি দিতে হয়েছে।
লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘কবরী’ পড়ে মনে হয়েছে–হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে না রাখতে পারলে শিল্পী হওয়া যায় না।