নামে ১০০, সেবা ৫০ শয্যার

চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স । চিকিৎসক সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত । ২০ লাখ মানুষের সেবাকেন্দ্রটি

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাঁচ উপজেলার মোহনা হচ্ছে চকরিয়া। গুরুত্ব বিবেচনায় বিগত সরকার চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করে। পুরনো ভবন থেকে দাপ্তরিক কার্যক্রম সরিয়ে নতুন ভবনে স্থানান্তর করার পর গত তিন বছর ধরে এখানেই চলছে স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রম। কাগজেকলমে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০০ শয্যার হলেও বাস্তবে ৫০ শয্যার আদলে মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক ও কনসালটেন্ট দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। এতে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার সাড়ে ৬ লাখ মানুষের পাশাপাশি আশপাশের আরও পাঁচটি উপজেলা থেকে আগত রোগীরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে নতুন হাসপাতাল কমপ্লেক্স ও প্রয়োজনীয় ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে গেলেও ১০০ শয্যা হাসপাতাল চালু করার প্রশাসনিক অনুমোদন এখনও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গৃহীত হয়নি। অপরদিকে বিদ্যমান ৫০ শয্যা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দকৃত প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও কনসালটেন্ট না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের কার্যক্রম।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বিদ্যমান ৫০ শয্যা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার বিপরীতে পদ রয়েছে ২২ জন চিকিৎসক। তদ্মধ্যে ১১ জন করে মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্ট। সেখানে বর্তমানে দুই পদে কর্মরত রয়েছেন ৬ জন করে। কিন্তু কাগজেকলমে চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছেন বলে উল্লেখ থাকলেও একজন করে মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্ট সংযুক্তি হিসেবে প্রেষণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই কর্মরত রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গাইনি বিভাগের একমাত্র কনসালটেন্ট ডা. মাকসুদা বেগম ঢামেকে প্রেষণে কর্মরত রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তারা অবশ্য বেতনভাতা গ্রহণ করছেন চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত হিসেবে। এছাড়াও সাকিব আল রাফিক নামের একজন চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন। আবার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন এক নারী চিকিৎসক। অপরদিকে চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মরত রয়েছেন পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে তিনি বেতনভাতা গ্রহণ করছেন চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক হিসেবে।

অপরদিকে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে অবস্থিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিটির বিপরীতে ১৮ জন মেডিকেল অফিসার কর্মরত থাকার কথা। সেখানে বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ৯ জন। তদ্মধ্যে ৩ জন দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত এবং একজন অন্যত্র কর্মরত রয়েছেন। সেই হিসেবে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ৫ জন।

৫০ শয্যার চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য পদের বিপরীতে চিকিৎসক না থাকায় চকরিয়াসহ আশপাশের ২০ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টিআইবিচকরিয়ার সচেনত নাগরিক কমিটির সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন জিয়া। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, কয়েকবছর আগেই সরকারি এই হাসপাতালটিতে ১০০ শয্যায় উন্নীতের জন্য প্রয়োজনীয় ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদন না হওয়ায় ১০০ শয্যার বিষয়টি কাগজেকলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। এর বাইরে বিদ্যমান ৫০ শয্যার বিপরীতে শূন্য পদে প্রয়োজনীয় মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্ট না থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই অঞ্চলের মানুষ। সনাক কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন জিয়া আরও বলেন, একমাত্র সরকারি এই হাসপাতালটি দুরবস্থা নিয়ে কারোরই যেন নেই ভ্রুক্ষেপ। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে দিনের পর দিন চকরিয়াসহ আশপাশের ২০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হবেন। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সুদৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।

আরও নানা সংকট : বান্দরবানের লামা ও আলীকদম এবং কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী উপজেলার অন্তত ২০ লাখ মানুষ প্রতিদিন চকরিয়ার ওপর দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন। এসব উপজেলার মানুষ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ভিড় করেন। এই হাসপাতালে সরকারি দুটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একজন অসুস্থ চালকই একমাত্র ভরসা। তাই নিয়মিত অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করা বেশ দুরুহ ব্যাপার ছাড়াও পর্যাপ্ত জ্বালানি তেলের সংকটে একটি অ্যাম্বুলেন্সটি বন্ধ থাকায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়াও এইচজিএসপি প্রকল্পের আওতায় ৫৮ জন কর্মকর্তাকর্মচারী এই হাসপাতালে বিভিন্ন দপ্তরে সেবাকাজে নিয়োজিত থাকলেও গত বছরের জুলাই মাস থেকে প্রকল্পটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এমনকি প্রকল্পটির আওতায় একজন টেকনোলজিস্ট দ্বারা আলট্রাসনোগ্রাফির জন্য যন্ত্র থাকলেও তাও বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে হাসপাতালে আগত ডেলিভারি রোগীদের জন্য বিশেষজ্ঞ গাইনি চিকিৎসক মাকসুদা বেগমকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি প্রেষণে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত থেকে কয়েকদিন আগে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে বদলি হয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে চর্মযৌন রোগের চিকিৎসক শামীমা সুলতানাকে দিয়ে গর্ভবতী নারীদের নরমাল ডেলিভারি ও সিজারিয়ান অপারেশন করানো হচ্ছে।

নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন সদ্য যোগদানকারী চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ জায়নুল আবেদীন। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, আশপাশের পাঁচ উপজেলার মোহনার চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন আগত রোগীর সংখ্যা অন্তত দেড় হাজার। এতসংখ্যক রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থা পোহাতে হচ্ছে হাসপাতালে কর্মরত সকলকে।

উপজেলা স্বাস্থ্য প্রধানের ভাষ্য, ১০০ শয্যার ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ অনেক আগেই হলেও মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন না হওয়ায় ৫০ শয্যার কার্যক্রমই চলছে। তাও আবার ২২ জন ডাক্তারকনসালটেন্টের শূন্য পদের বিপরীতে মাত্র ৫৬ জন চিকিৎসককনসালটেন্ট দিয়েই স্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম চালিয়ে নিতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের। এই পরিস্থিতিতে ‘সেবার দরজা খোলা’ থাকলেও চাহিদানুযায়ী চিকিৎসক সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

তবে আশার কথা শুনিয়েছেন কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. আসিফ আহমেদ হাওলাদার। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সার্বিক বিষয় আমি অবগত রয়েছি। তাই প্রতিনিয়ন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত এবং মৌখিকভাবে বারংবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় ডাক্তারকনসালটেন্ট পদায়ন করতে। সিভিল সার্জন আসিফ আহমেদ হাওলাদার আরও বলেন, আজ (গতকাল) কক্সবাজারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসছেন। তার সঙ্গেও চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানামুখী সমস্যার বিপরীতে করণীয় নিয়ে আলাপ হবে। আশা করছিএই আলাপে একটা ভাল ফলাফল আসতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৩ দিনে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩০৫ দর্শনার্থী
পরবর্তী নিবন্ধশাহাজাদা সৈয়দ মোহাম্মদ বেলায়েত উল্লাহ খানের জানাজা কাল