চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম নান্দনিক নগর হিসাবে গড়ে তুলতে যেসব কাজ করবেন দৈনিক আজাদীর একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি সেগুলো তুলে ধরেছেন সাবলীল ভাষায়। তবে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপির উদ্বিগ্নতার ব্যাপারে তিনি বলেন, জনসমর্থন হারানো ক্ষয়িষ্ণু বিএনপি বিলীন হয়ে যাবে।
আজাদী : মেয়র নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে কী উদ্যোগ নেবেন?
রেজাউল করিম চৌধুরী : চট্টগ্রাম নগরীর জন্য জলাবদ্ধতা অবশ্যই একটি সমস্যা। এটি সমাধানে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে জলাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে হলে আরও কাজ করতে হবে। নতুন খাল খনন করতে হবে। পুরনো খাল যেগুলো ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো পুনঃখনন করতে হবে। নালা-নর্দমা প্রশস্ত করতে হবে, জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। মোট কথা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আজাদী : স্বাস্থ্যসেবায় আপনার পরিকল্পনা কী?
রেজাউল করিম : করোনাকালীন আমি দ্বিতীয় যে সমস্যাটি দেখেছি সেটি হলো স্বাস্থ্য সমস্যা। হাসপাতালগুলোতে অঙিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেশনের অভাবে অনেক মানুষ মারা গেছে। তাই আমি মেয়র নির্বাচিত হলে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেব যাতে নগরবাসী বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা পায়। প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা গেলে মানুষের দুর্ভোগ অনেকটা লাঘব হবে।
আজাদী : রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রেজাউল করিম : উন্নয়ন করতে গেলে রাস্তাঘাটে খোঁড়াখুঁড়ি করতেই হবে, কিন্তু আমি যেটা লক্ষ্য করেছি সেটা হলো আমাদের সেবা সংস্থাগুলো যেমন- ওয়াসা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পিডিবি, সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আজ হয়ত রাস্তায় কার্পেটিং করা হলো, আগামী মাসেই কোনো একটি সংস্থা সেই রাস্তা খুঁড়ে ফেলল। আমি সেই সমন্বয়হীনতাকে দূর করব যাতে মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
ছোটবেলায় দেখেছি চট্টগ্রাম একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর ছিল। আমাদের এ শহরটি এখন ধুলাবালির শহরে পরিণত হয়েছে। আমার মনে হয় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের জন্য একটি শহরে যেরকম পরিবেশের প্রয়োজন সেরকম পরিবেশ আর নেই। শহরটি এখন জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় চলাচল করলে দেখা যায় ধুলাবালি নাকে-মুখে এসে ঢুকছে। এভাবে চলতে হলে তো মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। আমার মনে হয় যথেষ্ট জনবল থাকার পরও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এ সমস্যাটি সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারটিকে প্রাধান্য দিয়ে আমি ধুলাবালির বিষয়টিকে মোটামুটি একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।
আজাদী : ময়লা আবর্জনার ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী হবে?
রেজাউল করিম : নগরীর ময়লা-আবর্জনা দূর করার জন্য যে ডোর-টু-ডোর কার্যক্রম এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এটিতে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এ কার্যক্রমে প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ জনবল থাকলেও অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং জনগণ প্রকৃত সেবা পাচ্ছে না। তবে এটাও সত্য যে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আগে যে আবর্জনার স্তূপগুলো দেখা যেত এখন সেটা অনেক কমে গেছে, কিন্তু অলিগলিতে এখনও রয়ে গেছে। তাই মানুষ দুর্গন্ধে একটা অসহনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
আজাদী : মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে কী উদ্যোগ নেবেন?
রেজাউল করিম : নালা-নর্দমাগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয় না। যার ফলে বৃষ্টি হলে সেগুলো থেকে পানি উপচে পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আবার সাধারণ সময়ে সেখানে মশা ডিম পেড়ে বংশ বৃদ্ধি করে যে কারণে মশার উৎপাত অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার আগে পৌরসভা থাকার সময় যেভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হতো এখন সেভাবে ছিটানো হয় না কিংবা ছিটানো হলেও ওষুধগুলোর কার্যকারিতা সেরকম নেই বলেই মনে হয়। আমি মেয়র নির্বাচিত হলে এ সমস্যাটির দিকে অবশ্যই নজর দেব।
আজাদী : খেলাধুলা, বিনোদনের ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী হবে?
রেজাউল করিম : আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে; কিন্তু তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। তাদের জন্য খেলাধুলার পর্যাপ্ত মাঠ নেই, বিনোদনের সুযোগ নেই। তাই তাদের সৃজনশীল প্রতিভার সঠিক বিকাশ হচ্ছে না। প্রতিটি ওয়ার্ডে তো আর মাঠ করা সম্ভব নয়। তবুও কয়েকটি ওয়ার্ড মিলিয়ে হলেও যদি ছোট ছোট মাঠ তৈরি করে দেয়া যায় যাতে শিশু-কিশোররা খেলতে পারে আমি সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।
নগরীতে দিন দিন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা যেখানে-সেখানে আড্ডা দিয়ে সময় অপচয় করছে। আমি তাদেরকে দোষ দেব না কারণ তারা তো সৃষ্টিশীল কোনো কাজে যোগ দেয়ার পথ পাচ্ছে না। ফলে মাদক, সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাং এগুলো বেড়ে যাচ্ছে। যদি শহরে কিছু স্পট খুঁজে বের করে সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ, মুক্তমঞ্চ গড়ে তোলা হয় তাহলে শিশু-কিশোররা বিপথগামী হবে না। একসময় আমরা দেখতাম শীতকাল আসলে পাড়ায় পাড়ায় নাটক করার ধুম পড়ে যেত। মাসের পর মাস রিহার্সাল হতো। শিশু-কিশোর সহ সবাই এতে ব্যস্ত থাকত। তাই তাদের অপরাধে জড়ানোর সুযোগ ছিল না কিন্তু এখন সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। আমি সংস্কৃতি এবং বিনোদনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে চাই।
আজাদী : পরিকল্পিত ও পর্যটন নগরী হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়তে আপনার পরিকল্পনা কী?
রেজাউল করিম : চট্টগ্রাম বিধাতার একটি অপূর্ব সৃষ্টি। এখানে আছে কর্ণফুলী নদী, বঙ্গোপসাগর, সমুদ্র সৈকত, ছোট-বড় পাহাড়, সবুজ বন-বনানী। সেইসাথে আছে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত বিভিন্ন স্থান অর্থাৎ এখানে পর্যটক আকর্ষণের অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আমরা চট্টগ্রামকে সেভাবে গড়তে পারছি না বলে চট্টগ্রাম আজকে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। আমি মনে করি নদী, সাগর, পাহাড়, বন-বনানী ইত্যাদিকে নিয়ে যদি চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এ শহর থেকে একটি ভালো রাজস্ব আয় করতে পারবে।
একজন লোক সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয় না। হয়ত আমার মাথায় চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি মাথায় এসেছে। কিন্তু আমি একা এটা পারব না। এজন্য আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে কাজে লাগাতে হবে। তাই চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনাবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে যা টেকসই হয় এমন সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করলে আমার মনে হয় চট্টগ্রামকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পর্যটনের জন্য একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু নয়। চট্টগ্রামকে মাদক-সন্ত্রাসমুক্ত, নান্দনিক নগরী হিসেবে গড়তে হলে সবার পরামর্শকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
আজাদী : কিশোরগ্যাং বিষয়ে আপনার উদ্যোগ কী হবে?
রেজাউল করিম : বর্তমানে আরেকটি বিষয় নজরে আসছে যা হলো ‘কিশোরগ্যাং’। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে আমরা কেউ ভাবছি না। তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্তের। তাদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই, খেলাধুলার কোনো সুযোগ নেই। তারা ফুটপাতে খায়, ফুটপাতে ঘুমায়, ফুটপাতে বড় হয়। আমি ভাবছি তাদের জন্য যদি কোনো কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় যাতে তারা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে কিছু করে খেতে পারে, পরিবার চালাতে পারে তাহলে তারা আর অপরাধে জড়াবে না। তখন কিশোরগ্যাং সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।
আজাদী : হকারদের নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
রেজাউল করিম : হকারদেরও ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই একটি নিয়মের মধ্যে এনে। আমি বিশ্বের অনেক দেশেই দেখেছি হকাররা ফুটপাতে ব্যবসা করছে। তারা রাস্তাঘাটে জ্যাম সৃষ্টি করে ব্যবসা করছে না। এখন আমরা যদি হকারদের হঠাৎ করেই তুলে দিই, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে তার পুঁজিটা ধ্বংস করে দিই তাহলে তো তারা চুরি করবে কিংবা কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। অনেক রাস্তা আছে যেগুলোতে সবসময় যান চলাচল খুব বেশি থাকে না। এরকম রাস্তাগুলোতে যদি হকারদের নির্দিষ্ট সময় বসতে দেয়া হয় তাহলে জনগণেরও অসুবিধা হলো না আবার অনেকগুলো পরিবারও চলতে পারল। আমরা এখন তাদেরকে একবার তুলে দিই। তারা কিছুদিন পর একই জায়গায় আবার বসে যায়। এটাতো কোনো সমাধান হলো না। তাদের একটা নিয়মের মাধ্যমে ব্যবসা করার, পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আজাদী : নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপির উদ্বিগ্নতার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রেজাউল করিম : তারা সবসময় বলেছে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু করতে পারবে না, ডিজিটাল বাংলাদেশ সেটা আবার কী, কিন্তু আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু তৈরি করেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশও হয়েছে, বড় বড় প্রকল্পগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছে, ফেল তো একটাও করেনি। তারা কোনোদিন বলেনি যে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু করে ভালো কাজ করেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ করে ভালো কাজ করেছে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে ভালো কাজ করেছে, বছরের শুরুতে স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে বই দেয়া হচ্ছে ভালো কাজ করেছে। তারা শুধু বায়বীয় কথা বলে। এটা সুষ্ঠু হবে না, ওটা সুষ্ঠু হবে না। মানুষ যদি নৌকা থেকে সাগরে পড়ে যায় তাহলে খড়কুটা ধরেও বাঁচতে চায়। এখন বিএনপিরও হয়েছে সেই অবস্থা। আমি মনে করি দলটি এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু দল। এটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। কারণ দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দলটি গড়েছিলেন বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে এক জায়গায় এনে। এভাবে হয়ত কিছুদিন ক্ষমতায় থাকা যায় কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন গড়া যায় না। তারা জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে, মানুষের কাছে তারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত, তারা অর্থ পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোতো আওয়ামী লীগ সরকার প্রকাশ করেনি, প্রকাশ করেছে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের সরকার। বিএনপির সময়ের ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আমরা কি ভোটকেন্দ্রে যেতে পেরেছি, ভোট দিতে পেরেছি? তারা আমাদের লোকজনকে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, কুপিয়ে বের করে দিয়েছে। তাদের কাউকে কি আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে?
আজাদী : মেয়র হওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
রেজাউল করিম : আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য ইতিবাচক অনেক কিছুই করেছে। আমি মেয়র নির্বাচিত হলে যেসব উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছি এ নগরীর জনগণ সেগুলোকে স্বাগত জানাবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করব চট্টগ্রামকে সবার কাছে ইতিবাচকভাবে গড়ে তুলতে। তাই আমি মনে করি এ নগরীর জনগণ নগরীর উন্নয়নের জন্য, একটি নান্দনিক নগরী উপহার দেয়ার সুযোগ দিতে আমাকে মেয়র নির্বাচিত করবে।
সাক্ষাতকার গ্রহণে : প্রবীর বড়ুয়া