নানা প্রতিকূলতার পরও কন্টেনার ও খোলা পণ্য (কার্গো) হ্যান্ডলিংয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে চট্টগ্রাম বন্দর। থ্রি মিলিয়ন ক্লাবের সদস্য থাকা নিয়ে যেখানে সংশয় দেখা দিয়েছিল সেখানে রেকর্ড ৩৩ লাখ টিইইউএসের কাছাকাছি কন্টেনার এবং প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং করেছে বন্দর। এটা আগের বছরের তুলনায় প্রায় পৌনে দুই লাখ টিইইউস কন্টেনার এবং প্রায় ৩৫ লাখ টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং বেড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ছাত্র–জনতার আন্দোলন ঠেকাতে দিনের পর দিন সাধারণ ছুটি, কারফিউ, গণঅভ্যুত্থান, এলসি খোলা বন্ধ, ডলার সংকটসহ বিদায়ী বছরজুড়ে বিভিন্ন সময় প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও এমন অর্জন অনন্য বলে মন্তব্য করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বিষয়টি তুলে ধরতে আজ বুধবার সকালে বন্দর ভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরে ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৭৫ টিইইউএস কন্টেনার এবং ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭৯ টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। এ সময়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে ৩ হাজার ৮৬২টি। চলতি বছরের মে মাসে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ১৯৩ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে কম ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৬ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছে।
বন্দরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬২ কন্টেনার, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৬, মার্চে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৭৪, এপ্রিলে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৯, মে মাসে ৩ লাখ ১৯৩, জুনে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭৩, জুলাইয়ে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৫, আগস্টে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৯, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৪, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৯ এবং নভেম্বরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৮ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ডিসেম্বরের ৩০ দিনে হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৩ টিইইউএস কন্টেনার। গতকালের মোট হিসাব প্রকাশ করা হবে আজ সকাল ৮টায়। ধারণা করা হচ্ছে, দিনে গড়ে দশ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হলেও ২০২৪ সালে বন্দরের মোট কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ৩২ লাখ ৮০ হাজার টিইইউএসের কাছাকাছি হবে।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে এত কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের ইতিহাস নেই। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ও এর আওতাধীন কমলাপুর কন্টেনার ডিপো এবং পানগাঁও নৌ টার্মিনাল দিয়ে আমদানি–রপ্তানি পণ্য বোঝাই এবং খালি কন্টেনার মিলে মোট হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউস। ২০২২ সালে ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫০৪, ২০২১ সালে ৩২ লাখ ১৪ হাজার, ২০২০ সালে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭, ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭, ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ এবং ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।
বিদায়ী বছরের গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা পণ্য (জেনারেল কার্গো) হ্যান্ডলিং করেছে ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭৯ টন। আজ সকাল ৮টায় বিদায়ী বছরের সর্বমোট হিসাব করলে এ সংখ্যা ১২ কোটি ৪০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ১২ কোটি ২ লাখ টন, ২০২২ সালে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮২ টন, ২০২১ সালে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টন, ২০২০ সালে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার টন এবং ২০১৯ সালে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার টন পণ্য হ্যান্ডলিং করেছিল। বিদায়ী বছরে আগের বছরের তুলনায় ৩৫ লাখ টনের বেশি খোলা পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কন্টেনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বাড়লেও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা কমেছে। ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩ হাজার ৮৬২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে। ২০২৩ সালে জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছিল ৪ হাজার ১০৩টি। ২০২২ সালে জাহাজের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৬১টি, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৫৪টি, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৭২৮টি এবং ২০১৯ সালে ছিল ৩ হাজার ৮০৭টি।
জাহাজ আসার পরিমাণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বন্দর সচিব ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, কন্টেনার জাহাজ আসা কিছুটা কমলেও ব্যাপারটি গুরুতর নয়। আগের তুলনায় এখনকার জাহাজগুলো বড়। আগে ছোট জাহাজে যে পরিমাণ কন্টেনার আনত, এখন বড় জাহাজ তার চেয়ে বেশি কন্টেনার নিয়ে আসা–যাওয়া করছে। বন্দরে এখন সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে। আগে সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যেত। আগে হাজার–বারোশ কন্টেনার নিয়ে জাহাজ ভিড়ত বন্দরের জেটিতে। এখন সেখানে দুই–আড়াই হাজার টিইইউএসের বেশি কন্টেনার বোঝাই জাহাজ ঢুকছে। এমনকি ২৮০০ কন্টেনার নিয়েও জাহাজ এসেছে। তাই জাহাজ কম আসার ওপর বন্দরের পারফরমেন্স নির্ভর করেনি।
তিনি বলেন, জুলাই–আগস্টে কিছুদিন অস্থিরতার মধ্যে কাটলেও বাকি সময় চট্টগ্রাম বন্দর অতীতের মতোই নিরবচ্ছিন্নভাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারটি প্রতি বছর দু–চারদিন হয়ে থাকে। বন্দরের বহরে নতুন অনেক যন্ত্রপাতি সংযোজিত হয়েছে। এতে বন্দরের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর প্রভাব কন্টেনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে পড়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারী এবং কর্মকর্তারা বলেন, বিদায়ী বছরে বৈশ্বিক স্থবিরতা ছিল। বিশেষ করে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং ডলার সংকট পরিস্থিতি নাজুক করে তোলে। ব্যাংকে এলসি খোলার কড়াকড়িতে আমদানি তলানিতে নেমে এসেছিল। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। বৈশ্বিক সংকট দেশের রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
তারা বলেন, এর মধ্যে জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় বন্দরে কন্টেনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং কিছুদিন প্রায় বন্ধ ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। রিজার্ভও বাড়তে থাকে। এর ফলে বছরের শেষ দিকে এসে আমদানি–রপ্তানি আবার বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বন্দরে কন্টেনার এবং কার্গো হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি ছন্দে ফিরে আসে। রেকর্ড ভাঙা এই অর্জন শুধু বন্দরের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও সুখবর।