পরিবহনের আড়ালে সরকারের আমদানিকৃত ৬শ কোটিরও বেশি টাকা দামের সার গায়েব করে দেয়ার ঘটনার কোনো কূল–কিনারা হয়নি। তদন্ত হয়েছে, তদন্তে ঘটনা উদঘাটিতও হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিঠির পর চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু সরকারের সার আর ঢুকেনি সরকারি গুদামে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) আমদানি করা এই সার উদ্ধারে বহুমুখী চেষ্টা শেষতক ব্যর্থ হতে চলেছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
বিসিআইসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের কৃষি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সার ইউরিয়া। এই সার দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চড়াদামে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত সার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের সরবরাহ দেয়া হয়। দেশের ইউরিয়া সারের পুরোটাই সরকার নিয়ন্ত্রিত। দেশের প্রায় ৬০ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের সারের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টনের কাছাকাছি। দেশীয় বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার দিয়ে কৃষকের চাহিদার যোগান দেয়া হয়। সরকার আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর সুপারিশ ও চাপ উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে এসব সার কৃষকদের যোগান দিয়ে থাকে। বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৫টি সরকারি গুদামে (বাফার গুদাম) পরিবহন করা হয়। বিসিআইসির নিয়োজিত পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমে এসব সার পরিবহন করা হয়। এই ধরনের একটি পরিবহন ঠিকাদার চট্টগ্রামের নবাব এন্ড কোম্পানি। তারা বন্দর থেকে গুদামে পৌঁছানোর জন্য সার নিলেও সেগুলো পৌঁছায়নি। পথিমধ্যে এসব সার হাওয়া করে দেয়া হয়েছে। ২০১৯–২০ ও ২০২০–২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৮৭৪ টন সার পুরোপুরি গায়েব করে দেয়া হয়। হাওয়া করে দেয়া সারের দাম প্রায় ৬২০ কোটি টাকা।
বিসিআইসি সূত্র জানায়, পরিবহনের কার্যাদেশ পাওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে সারের চালান গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু এতদিন গত হলেও সেই সারের কোনো হদিশ নবাব এন্ড কোম্পানি দিতে পারেনি। বিসিআইসি থেকে কয়েক দফা তাগিদপত্র দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। বিসিআইসি থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে নবাব এন্ড কোম্পানি। দীর্ঘ প্রায় চার বছর গত হতে চললেও নবাব এন্ড কোম্পানি ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
বিসিআইসি থেকে ঢাকার মতিঝিল থানায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনোয়ারা থানা এলাকার বাসিন্দা নবাব খানের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার এজাহারে বলা হয়, এমভি জিন্দা নামের একটি জাহাজ কাতার থেকে ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ওই সার খালাস হয় ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। অপর দিকে এমভি সি বেনিভোলেন্স জাহাজে করে সৌদি আরব থেকে কেনা সার খালাস হয় ওই বছরের ১১ নভেম্বর। এরপর ওই একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর এমভি গোল্ডেন লিফ–২ নামের একটি জাহাজ সৌদি আরব থেকে সার নিয়ে আসার পর সেটিও খালাস করা হয়। সর্বশেষ গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এমভি ইলমা নামের জাহাজে সৌদি আরব থেকে আনা সার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালাস করা হয়েছে।
বিসিআইসির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, কাতার ও সৌদি আরব থেকে ১ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টন সার আমদানি করে সরকার। মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোম্পানি এই সার পরিবহন করে গুদামে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেয়। তারা সারের হিসেবপত্র বুঝে নেয়। কিন্তু এর মধ্যে ৬৬ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন সার তারা গুদামে পৌঁছায়নি। তাদেরকে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও কাজ না হওয়ায় মামলা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার পোটন ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানও একই ঘটনা ঘটিয়েছে। পোটন ট্রেডার্সের মালিক নরসিংদী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন (বিএফএ) সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান পোটন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন। পোটন ট্রেডার্সের কয়েকজন কর্মকর্তাও জেলে রয়েছেন। কিন্তু একই ধরনের অপরাধ করেও নবাব খান ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। বিসিআইসির শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
সার গায়েব এবং মামলার ব্যাপারে নবাব খানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। নবাব এন্ড ট্রেডার্সের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা নিয়েও অনিশ্চয়তা চলছে বলেও ওই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।