শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা নানারকম হয়রানি থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। তাঁরা কর আদায়ের নামে হয়রানি ও জটিলতার অবসান চেয়েছেন। একই সঙ্গে উৎপাদন পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। আগামী অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর যৌথ আয়োজনে এনবিআরের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় এ দুটি বিষয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ ছিল বেশি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বুধবার অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সভাপতিত্ব করেন।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভ্যাট আদায়ে কিছু অযৌক্তিক কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এগুলো ভ্যাট কর্মকর্তারা আটকে রেখে অযথা সময়ক্ষেপণ করেন। এতে ব্যবসায়ীরা নানা ঝামেলায় পড়েন। এসব পরিহার করতে হবে।
ব্যবসা–বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়েছে উল্লেখ করে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, এক সময় বস্ত্র খাতের যন্ত্রাংশ আমদানিতে ছাড়পত্র বিটিএমএর পক্ষ থেকেই দেওয়া হতো। কিন্তু এনবিআর পুরো বিষয়টি নিজের হাতে নেওয়ার পর জটিলতা বেড়েছে। প্রতিটি ধাপে ছাড়পত্র নিতে হয়। দেখা যায়, ৩০ হাজার টাকা শুল্ককর জমা দিতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, তারা কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেও দুই বছরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তার ভাষায় ‘আমরা বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য ডাকছি। অথচ নিজের দেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানি সংকটে ভুগছেন।’
বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, এইচএস কোড নিয়ে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। তিনি বলেন, ফাইবার রিসাইকেলের ক্ষেত্রে মোট ২২ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। অথচ অন্যান্য দেশ এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেন। তাই তিনি এ ভ্যাট অব্যাহতির দাবি জানান। এমসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, করের আওতা সমপ্রসারণের আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে যারা কর দেন, তাদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। তাছাড়া ব্যবসা পরিচালনার অনেক খরচ অনুমোদন হয় না। তাই ঘোষিত হারের চেয়ে কার্যকর কর অনেক বেড়ে যায়।
ঢাকা চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি রাজীব চৌধুরী বলেন, সরকারের মোট রাজস্বের ৮৪ শতাংশ আসছে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে। অন্যান্য জেলা থেকে রাজস্ব আসছে না। এসব জেলা থেকে কর আদায় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তিনি কর প্রদান সহজ করার ওপর জোর দেন। সভায় ব্যবসা ও বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। তিনি সুনির্দিষ্ট এবং গঠনমূলক বাজেট প্রস্তাবনা দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জরুরি ব্যবসায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। ব্যবসায়ীরা যেসব হয়রানির শিকার হন, সেগুলো দূর করা। তাঁরা বলেন, ব্যবসায়ীরা পূঁজি, বিদ্যুৎ, গ্যাস পেতে হয়রানির শিকার হন। কাস্টমস–এনবিআরেও নানাবিধ অব্যবস্থাপনার শিকার হন তাঁরা। সরকার নির্ধারিত ট্যাক্স–ভ্যাট দিয়েও হয়রানির শিকার হতে হয়। বন্দরে আমদানিকৃত মালামাল মাসের পর মাস আটকিয়ে রাখা হয়। আইনের সুযোগে অনেক ঝামেলা চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের উপর। এ সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। তাঁরা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নানা রকম হয়রানিসহ হত্যা মামলাও করা হয়েছে। আর মামলাকে হাতিয়ার বানিয়ে কয়েকটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
অনেকে ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ গিয়ে ফেরত আসতে চাইলেও পরিস্থিতি অনুকূল মনে করছেন না। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি নিরীহ মানুষও রয়েছেন। ফলে দেশের সার্বিক ব্যবসা–বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক না কাটলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে ব্যবসায়ীদের রেহাই দিতে পারে একমাত্র সরকার। এ বিষয়ে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।