মোড়ে মোড়ে গাড়ির জটলা, অবৈধ পার্কিং, উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তা জুড়ে খানাখন্দক মিলে এক ভয়াবহ রকমের নাজুক অবস্থায় পড়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর ট্রাফিক সিস্টেম। শহরের প্রায় প্রতিটি মোড় ঘিরে দিনভর যানজট চলে। যানজট চলে রাতেও। যানজটে স্থবির হয়ে যাওয়া নগরজীবনে নয়া আপদ ‘উল্টো পথের গাড়ি’। সবকিছু মিলে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু না করলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। নগর পুলিশ বলেছে, ট্রাফিক পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে যানজট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। রাস্তাগুলো ঠিকঠাক হয়ে গেলে নগরীর যান চলাচলে প্রত্যাশিত গতি আসতো বলেও পুলিশ দাবি করেছে।
গতকাল নগরীর বহদ্দার মোড়, মুরাদপুর মোড়, চকবাজার, চমেক হাসপাতালের সামনে, প্রবর্তক মোড়, গোলপাহাড় মোড়, জিইসি মোড়, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, ওয়াসা মোড়, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়, বারিক বিল্ডিং মোড়, বড়পুল মোড়, নয়াবাজার মোড়, এ কে খান মোড়সহ বিস্তৃত এলাকা ঘুরে এক ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি মোড়েই অগুনতি ব্যাটারি চালিত এবং প্যাডেল রিকশার দখলে। রাস্তার একটি বড় অংশ দখল করে থাকা রিকশা এবং সিএনজি টেঙির পাশে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করছে বাস। রিকশা টেঙি এবং বাসের এক একটি ভয়াল জটলার পেছনে আটকা পড়ে রয়েছে শত শত গাড়ি। এই দৃৃশ্য শুধু একটি মোড়ের নয়, শহরের প্রায় প্রতিটি মোড়ের। শুধু মোড়গুলোকে অবৈধ জটলা মুক্ত রাখতে পারলে শহরের যানজট অর্ধেকে নেমে আসবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
শুধু মোড়গুলোই নয়, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোড, কমার্স কলেজ রোড, শহরের প্রতিটি নামী দামি স্কুলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে শত শত গাড়ি। শেখ মুজিব রোডের রাস্তার অর্ধেক দখল করে চলে গাড়ির যন্ত্রপাতি এবং সাজসজ্জা বিক্রির বেসাতি। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তাজুড়ে চলে হরেক পণ্যের বাণিজ্য। রাস্তার উপর এই অবৈধ দখলদারিত্ব নগরীর ট্রাফিক সিস্টেমে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জিইসি মোড়ের চারপাশে যেভাবে ফুটপাত থেকে রাস্তার বড় অংশ ‘ভাড়া নিয়ে’ ব্যবসা করা হয় তাতে যান চলাচলে স্বাভাবিক গতি অকল্পনীয়।
শহরের নামি দামী এবং অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিরও নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে স্কুল চালু এবং ছুটির সময় যে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয় তার রেশ চলে কয়েক ঘন্টা ধরে। স্কুলগুলোকে নিজস্ব বাস চালুর ব্যাপারে দফায় দফায় তাগাদা দেয়া হলে কেউ কথা শুনেনি। ফলে শহরের যান চলাচলের ক্ষেত্রে বড় ধরণের সংকট অব্যাহত রয়েছে।
শহরের অলি গলি রাজপথ সর্বত্রই হাজার হাজার গর্ত, খানাখন্দক। শহরের একটি রাস্তাও আস্ত নেই। সবগুলোরই পিঠের চামড়া ক্ষয়ে গেছে। কাটাকুটিতেও ক্ষতবিক্ষত এক একটি রাস্তা। এসব রাস্তায় ২০ কিলোমিটারের বেশি বেগে গাড়ি চালানো কঠিন। তাছাড়া একটু পর পর ব্রেক কষতে গিয়ে দিশেহারা চালক, যাত্রী। থেমে থেমে চলার কারণে শহরজুড়ে যানজটে নাকাল মানুষ।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কাটাকুটিও শহরের যান চলাচলের ক্ষেত্রে বড় ধরণের সংকট সৃষ্টি করছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার চলমান প্রকল্পের কাজের জন্য কাটাকুটি এবং লাওয়ারিশভাবে রাস্তাগুলো পড়ে থাকার কারণে গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্র ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বন্দর থেকে হাজার হাজার গাড়ি প্রতিদিন নিমতলা থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত সড়কটিতে চলাচল করে। কিন্তু এই সড়কে ওয়াসার একটি প্রকল্পের জন্য রাস্তার বড় অংশ টিনের ঘেরা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতি শ্লথ গতির এসব কাজের দরুণ যান চলাচলে স্থবিরতা বিরাজ করছে। রাতে দিনে যানজট লেগে থাকে শহরের অতি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পোর্ট কানেক্টিং রোডে। যার জের ধরে শহরের অন্যান্য রাস্তায়ও যান চলাচলে গতিহীনতা তৈরি হয়েছে।
শহরে নতুন আপদ হিসেবে ‘উল্টো পথের গাড়ি’। শহরের বিভিন্ন রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে যান চলাচলের জন্য গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু শহরের বহু রাস্তাতেই মেডিয়ান গ্যাপ অনুসরণ না করে উল্টো পথে চলে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, সিএনজি টেঙি এবং মোটর সাইকেলের মতো গাড়ি। বিভিন্ন সময় প্রাইভেট কার ও হিউম্যান হলারগুলোকে দেখা যায় উল্টো পথ ধরে সামনে এগুচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই চলাচলে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে দুর্ঘটনা ঘটলেও সবচেয়ে বেশি সংকট সৃষ্টি করছে গাড়ির গতিতে। থমকে থমকে চলতে হয় গাড়িগুলোকে। নগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোড, বাকলিয়া এঙেস, আগ্রাবাদ এঙেস রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোডসহ বিভিন্ন সড়কে উল্টো পথের গাড়ির সংখ্যাধিক্য আতংকের কারণ হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিভিন্ন ধরণের সমস্যা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে চালকদের আইন না মানার প্রবণতা। ট্রাফিক পুলিশকে পাত্তা না দেয়া, কিংবা ট্রাফিক পুলিশ আইন মানতে বাধ্য করাতে অনীহা পুরো শহরকে স্থবির করে দিচ্ছে। পুলিশ যদি ট্রাফিক আইন মানতে যানবাহন চালকদের বাধ্য করে তাহলে অন্যান্য অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে একটি গতিশীল নগরী তৈরি হবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
গতকাল একাধিক সড়ক বিশেষজ্ঞ দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেছেন, বন্দর নগরীর চট্টগ্রাম অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। মেগাসিটির কাছাকাছিতে পৌঁছে যাওয়ার এমন একটি শহরে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ এলাকা রাস্তা থাকার কথা। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাস্তার পরিমান ৯ শতাংশেরও কম। রাস্তার পরিমান কমে যাওয়ার পাশাপাশি যানবাহনের বেপরোয়া সংখ্যা বৃদ্ধি এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শহরের প্রধান সড়ক বলতে বুঝায় বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটিকে। এশিয়ান হাইওয়ে খ্যাত এই রাস্তাটির কোথাও ছন্দপতন ঘটলে তার প্রভাব শুরু হয় নগর জুড়ে। এছাড়া অলংকার মোড় থেকে ট্রাংক রোড, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্যান্ড রোড, কাপাসগোলা রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড এগারশ’ কিলোমিটারের মতো রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে ৬শ’ কিলোমিটারের মতো রাস্তা পিচঢালা। যেখানে শহরের বেশিরভাগ গাড়িই চলাচল করে। সেই পিচঢালা রাস্তায় খানাখন্দকে ভরে উঠায় শহরের যান চলাচলে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেন। তারা রাস্তাগুলো দ্রুত সংস্কার এবং যান চলাচল উপযোগী করার পাশাপাশি ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের উপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। শহরে দ্রুত অটো ট্রাফিক সিস্টেম চালু করার জন্যও তারা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মহানগরী ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা যানজটের কথা স্বীকার করে বলেন, সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর আমাদের পুলিশ সদস্যদের প্রায় সকলেই কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। রাস্তায় দায়িত্বও পালন করছেন। কিন্তু এখনো সবকিছু পুরোপুরি ছন্দে ফিরে আসেনি। মোড়ে মোড়ে গাড়ির জটলা, অবৈধ পার্কিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর অবস্থানে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।