নগরীর নাছিরাবাদ এলাকার আকাশজুড়ে কালো মেঘের ভেলা ভাসে। তবে সবসময় প্রকৃতিসৃষ্ট মেঘ থাকে তা নয়, ওখানকার স্টিল মিলগুলোর ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে আকাশে মেঘের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় একটি কারখানার ধোঁয়ায় আশেপাশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অভিযোগ উঠেছে, এখানকার অনেক স্টিল কারখানায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (এপিসি) থাকলেও খরচ বাঁচাতে বেশিরভাগ সময়ে অনেকে বন্ধ রেখে খোলা আকাশে অপরিশোধিত কালো ধোঁয়া ছেড়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সরেজমিন নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রুবি গেইট সংলগ্ন সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে আকাশ। চুল্লির পাশাপাশি উন্মুক্তভাবেও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে নাছিরাবাদের আকাশে। শুধু সালেহ স্টিল নয়, শিল্প এলাকাটির আরো বেশ কয়েকটি স্টিল মিল থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়ে পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষণ করে চলেছে। পরিবেশ দূষণ করার অভিযোগ উঠার কারণে স্টিল মিলগুলোর বিরুদ্ধে নানা সময়ে জরিমানাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অনেক প্রতিষ্ঠান জরিমানা আদেশের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরে আপিলে হেরে গিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন ইতোমধ্যে।
সালেহ স্টিলের পাশের একটি মিক্সার প্লান্টে কথা হয়, প্লান্ট অপারেটর স্বরজিতের সাথে। তিনি বলেন, ‘কী সকাল, কী বিকেল কালো ধোঁয়ার কারণে এখানে কাজ করা যায় না। সালেহ স্টিলের কালো ধোঁয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। আমাদের অফিসগুলো কালো আস্তরণ জমে যায়।’
পার্শ্ববর্তী আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা খায়রুল আমীন বলেন, ‘কালো ধোঁয়ার কারণে অনেক সময় নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। ধোঁয়াতে বিদঘুটে গন্ধ অনুভূত হয়। এখানে পাশে একটি স্কুলও রয়েছে। করোনাকালের কারণে স্কুল বন্ধ রয়েছে। তবে খোলা থাকলে ধোঁয়ার দূষণের শিকার হতে হয় সবাইকে। প্রতিনিয়ত কালো ধোঁয়া বের হলেও কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা হয় না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নাছিরাবাদ শিল্প এলাকার মধ্য দিয়ে নাছিরাবাদ-অক্সিজেন সড়কের বাতাসে ধোঁয়ার একটা আস্তরন সবসময় লেগে থাকে। এতে মনে হয় এখানে সবসময় বায়ু দূষিত হয়। শিল্পের কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, নাছিরাবাদ শিল্প জোন হলেও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে শিল্পের ধোঁয়া বসতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাছাড়া কালো ধোঁয়ার দুষণে মানুষের শরীরে বায়ুবাহিত রোগের সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য এখানকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বাতাসে কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে বাতাসে এসপিএম (সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার) ২০০ পিপিএম মাত্রার অধিক হলে পরিবেশ আইন ভঙ্গ হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক ইকবাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় এখন খুব ভালমানের এয়ার পলিউশন কন্ট্রোল (এপিসি) লাগানো হয়েছে। ওখানে সাদা ধোঁয়া বের হয়। তারপরেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে গত সপ্তাহেও এসপিএম পরীক্ষা করে গেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে পরিশোধনকৃত ধোঁয়া ৮০ ফুট চুল্লি দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্য। আমরা বের করি ৯০ ফুট উচ্চতার চুল্লি দিয়ে। অথচ অনেকের এটাও নেই।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কারখানার সামনে একটি স্কুল রয়েছে। অথচ ৩৬ নং ক্লজে লিখা রয়েছে শিল্প এলাকায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যতিরেখে শিল্প কারখানা ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না। তাহলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লটে সাইডার স্কুল কিভাবে হলো।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নাছিরাবাদ শিল্প এলাকার প্রায় সবগুলো স্টিলমিলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের আদেশের বিরুদ্ধে কিছু স্টিল মিল কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তারপরেও নতুন করে অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর গবেষণাগার কার্যালয় ইতোমধ্যে নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় বেশ কয়েকটি স্টিল মিল থেকে ধোঁয়ার নমুনা সংগ্রহ করেছেন। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন পাওয়ার পর যাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।