নাগিন পাহাড় বাঁচবে না?

রাতের আঁধারে মাটি নিয়ে যান প্রভাবশালীরা পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে ভবন

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের অসংখ্য পাহাড়ের একটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার নাগিন পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সারলেও ঠেকানো যাচ্ছে পাহাড় কাটা। আবার ধসে পড়া মাটিও রাতের আঁধারে সরিয়ে নেয় প্রভাবশালী এবং দুষ্কৃতকারীরা। এভাবে নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা। প্রশ্ন উঠেছে, নাগিন পাহাড়কে রক্ষার দায় কার?
সরেজমিনে দেখা গেছে, নাগিন পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি হয়েছে বিশাল মাঠ। মধ্যখানে ৩০-৪০ ফুটের চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়েছে। আবার ওইস্থানে বিকেলে স্থানীয় ছেলেরা খেলছে। আবার পাহাড়টির আশেপাশে চারিদিকে নতুন করে গড়ে উঠছে স্থাপনা। এসব স্থাপনায় নাম উল্লেখ করে সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়েছে। আবার দেওয়ালে লিখেও মালিক সেজেছেন অনেকে। পাহাড়ের পাদদেশে কেউ ট্রাক দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। কেউ গ্যারেজ করছেন। আবার কেউ টিন বাঁশের ঘেরা দিয়ে দখল করেছেন। আবার পাহাড়টির লাগোয়া পাদদেশেও অনেক স্থাপনা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ে ইটভাটা ছিল পাহাড়টির পাদদেশে। পাহাড় কেটে ইটবানিয়ে বিক্রি করতেন এক প্রভাবশালী। পরে পরিবেশ আইনে দেশের মহানগরীগুলোতে কোন ইটভাটা না রাখার সরকারি ঘোষনা আসলে পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটাটি গুঁড়িয়ে দেয়। তারপরেও নাগিন পাহাড়কে রক্ষা করা যাচ্ছে না। কথা হলে দেলোয়ার নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে ছিপা একটি গলি ছিল। এখন অনেক বড় রাস্তা হয়ে গেছে। এখানে শাহাদাত কোম্পানির ব্রিকফিল্ড ছিলো। পাহাড়টি কেটে ব্রিকফিল্ড বানানো হয়েছিল। এরপর থেকে পাহাড়টি ধসে পড়ছে।’ মোমিন নামের এক যুবক বলেন, ‘নাগিন পাহাড়টি ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আগে অনেক বড় ছিলো, এখন ছোট হয়ে আসছে।’ নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখনে পাহাড়ের জায়গাতে কমপক্ষে ১০-১৫টি দালান উঠেছে। ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত হয়েছে দালানগুলো। আবার নাগিন পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি রাতের আধারেই প্রভাবশালীরা ট্রাকে করে নিয়ে যায়।’ স্থানীয় আরও অনেকের সাথে কথা বলতে চাইলে গড়ে উঠা দালানগুলোর বিষয়ে কেউ কথা বলতে চাননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে নাগিন পাহাড় হচ্ছে একটি আলোচিত পাহাড়। পাহাড়টির পাদদেশে ইটভাটা ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে ইটভাটাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও পাহাড়টি রক্ষা করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এক পুলিশ অফিসারের পাহাড় কাটার অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে বহুতল অনেক ভবন উঠেছে। ভবনগুলোর খতিয়ান পর্যালোচনা করে দেখাগেছে সবগুলোই পাহাড় শ্রেণির। বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে পাহাড়ি এ ভূমিতে দালালগুলো উঠেছে। দালানগুলো কিভাবে উঠেছে তা প্রশ্ন তৈরি করছে। আমরা সরেজমিনে দেখে কয়েকজনকে নোটিশ করেছি।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের এ পরিচালক জানান, ‘নাগিন পাহাড়ের পাশে ‘দিদার হাউজিং সোসাইটি’ নামের আবাসন গড়ে উঠেছে। দিদারুল আলম নামের ওই ব্যক্তি মারা গেছেন। ওখানে প্রায় দুই কানি জায়গার মালিক ছিলেন দিদার। পরে চার শতক জমির উপর ৭ তলা ভবন তৈরি করেন তিনি। অন্য সম্পত্তি কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। তন্মধ্যে মান্নান নামের এক ব্যক্তিকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আবারও ওই এলাকাটি ভিজিট করবো। ওখানে যতটুকু শুনেছি সিডিএ’র অনুমোদন নিয়েই বহুতল ভবনগুলো উঠেছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন পুরো এলাকাটিতে নাগিন পাহাড়ের অবস্থান ছিল। পাহাড় শ্রেণির জমিতে সিডিএ কিভাবে বিল্ডিং করার অনুমোদন দিয়েছেন, সেটিও আমরা খতিয়ে দেখবো।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পার্বত্য এলাকাবাদে দেশের কোন জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে এ ধরণের পাহাড় নেই। পাহাড় আমাদের জাতীয় সম্পদ। এসব পাহাড়কে রক্ষা করতে হবে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করেছি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় কিভাবে পাহাড়গুলো রক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বালিমাটিযুক্ত। শুধু দেওয়াল দিয়ে এসব পাহাড় রক্ষা করা দুরূহ। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে রক্ষার জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সরকারের কাছে দেবো।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন মাস পর চট্টগ্রামে মৃত্যুহীন দিন
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে নগর ছাত্রলীগ নেতার অস্বাভাবিক মৃত্যু