প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচজন মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে (চসিক)। এদের প্রত্যেকের স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রাম হবে সমৃদ্ধ নগরী। দায়িত্ব পালনকালে সে স্বপ্ন পূরণে তাদের প্রত্যেকে চেষ্টাও করেছেন। আন্তরিকতারও কমতি ছিল না তাদের। এরপরও সবসময় নাগরিক প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। এর অন্যতম কারণ ছিল আইনি সীমাবদ্ধতা।
চসিকের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯’ এর আলোকে। যেখানে নির্বাচিত মেয়রের ক্ষমতা নির্ধারিত। আইন দ্বারা বেষ্টিত মেয়রের অবস্থান অনেকটা ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ এর মতো। তাই মেয়রের পক্ষে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ হয় না। তাছাড়া আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে সরকারের অন্য সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারেন না। অথচ ভোগান্তিহীন টেকসই নাগরিক সেবা নিশ্চিতে নগরে বিদ্যমান সিটি কর্পোরেশনসহ অন্য সেবা সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বয় থাকা অপরিহার্য। এই অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে দাবি ওঠেছে আইন সংশোধন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ক্ষমতা বাড়ানোর। এক্ষেত্রে বলা হয়, ক্ষমতায়নের ফলে নগরের অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করা করা যাবে এবং
এর মধ্য দিয়ে মানসম্মত সেবা নিশ্চিতে সক্ষম হবে সংস্থাটি। যদিও বিভিন্ন সময়ে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও ক্ষমতায়নের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন আইন পর্যালোচনায় জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের পূর্বে ‘অর্ডিন্যান্স অব সিটি কর্পোরেশন-১৯৮২’র আলোকে দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো পরিচালিত হতো। আইনটির আলোকে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যারা মেয়র ছিলেন তারা বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারতেন। ওই সময় চট্টগ্রামের সাতটি সেবা সংস্থা তথা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, সিডিএ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের দপ্তরে প্রধানগণ সিটি কর্পোরেশনের ‘অফিসিয়াল কমিশনার’ ছিলেন। তারা মেয়রের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত প্রতি মাসের সমন্বয় সভায় উপস্থিত থাকতে বাধ্য ছিলেন। পরবর্তীতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা-ব্যবস্থাপকসহ অন্য সেবা সংস্থার প্রধানগণের উপস্থিতি অনেকটা আবশ্যক ছিল।
অবশ্য ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর ধারা ৪৯ এর উপ-ধারার আলোকে সমন্বয় নিশ্চিতে কিছুটা সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের আমন্ত্রণে বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রধানগণ ও তাদের প্রতিনিধিগণ সাধারণ সভায় যোগ দিতে পারবেন এবং বিভিন্ন মতামত দিতে পারবেন। যদিও বিগত সময়ে চসিকের সাধারণ সভায় বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রধানগণের উপস্থিতি ছিল না। মাঝেমধ্যে প্রতিনিধি হিসেবে যারা আসতেন তারাও গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নন। ফলে সমন্বয়ের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকে।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ২৭ জুন ‘সিটি কর্পোরেশনের সাথে সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দপ্তর সমূহের মধ্যে সমন্বয়’ করার জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘সিটি কর্পোরেশনের অধিক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের প্রধানগণ সিটি কর্পোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগদান করত: সভায় গৃহীত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করবেন’। এরপরও সমন্বয় নিশ্চিত না হওয়ায় ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, চসিক নিয়মিত সমন্বয় সভার আয়োজন করেছে। সভায় সকল উন্নয়ন কাজে চসিকের সাথে সমন্বয়ে বারবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাস্তবে কোনো সংস্থা-ই কার্যকর সমন্বয়পূর্বক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে না’।
এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে জারিকৃত পূর্বের পরিপত্রের নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণ’ করার নির্দেশ দিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ ১৫টি মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে নগরে অসংখ্য সমন্বয় সভা হয়েছে। এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রীও যোগ দেন সভায়। ওসব সভায় সমন্বয় নিশ্চিত করারও কথা বলেছিলেন সেবা সংস্থার প্রধান বা প্রতিনিধিগণ। এতকিছুর পরও নগর উন্নয়ন সমন্বয় নিশ্চিত হয়নি। কারণ, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯’ এর আলোকে আহূত সমন্বয় সভায় সেবা সংস্থার প্রতিনিধি না এলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ার বা ক্ষমতা নেই কর্পোরেশনের। ফলে সমন্বয় সভাগুলো ফলপ্রসূ হয়নি।
এ অবস্থায় নগরে প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে পুরনো চিত্র। অর্থাৎ সংস্কারের কয়েক মাস না পেরুতেই কাটা হচ্ছে সড়ক। এক্ষেত্রে বেশির ভাগই ঘটে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সড়ক সংস্কার করে। কিছুদিন পর সেই সড়ক ওয়াসা, টেলিকমিনিউকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বা অন্য কোনো সেবা সংস্থা কেটে ফেলেছে তাদের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে। সমম্বয়হীনভাবে কাজ করার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে চিটি কর্পোরেশন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে, ‘চসিকের অবকাঠামোয় (রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট, সেতু) বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কর্তৃক নিজস্ব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে কর্পোরেশনকে অবগত না করে অসমন্বিতভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পাদন করে। সংস্থাগুলোর সঙ্গে চসিকের কোনোরূপ সমন্বয় না থাকায় চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমে জনদুর্ভোগসহ নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে সরকারের ভাবমর্ূতি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সংস্থাগুলো চসিককে প্রকল্প বিষয়ে পূর্বে অবগত না করানোর ফলে অনেক সময় উন্নয়ন কার্যক্রমে ‘ওভারলেপিং’ হয়। চসিক এলাকায় সরকারের যেকোনো রূপ উন্নয়ন কার্যক্রম কর্পোরেশনকে অবগতকরণপূর্বক সম্পাদন করলে চট্টগ্রামকে জনদুর্ভোগহীন পরিকল্পিত নগরে পরিণত করা সম্ভব হবে।’
সমাধান কী : ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর চসিক প্রশাসকের গঠিত পরামর্শক কমিটির সভায় প্রয়োজনে আইন সংশোধন করেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। সমন্বয় সভায় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সদ্য সাবেক সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন বলেছিলেন, ‘স্থানীয় সরকার আইনে সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি সমন্বয় সভায় সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থা অংশগ্রহণের জন্য নির্দেশনা আছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিপত্রও আছে। কিন্তু অনুপস্থিত থাকলে বা সমন্বয় না করলে সংস্থাগুলোর প্রতি সিটি কর্পোরেশনের করণীয় নির্ধারণে কোনো বিধান নেই। অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয় সভাগুলোতে সংস্থা প্রধান না এসে একজন প্রতিনিধি পাঠানো হয়। অথচ সভায় উপস্থিত প্রতিনিধির কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা প্রদানের ক্ষমতা নেই। এতে করে সমন্বয়হীনতা রয়েই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।’
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর পরিবর্তে ঢাকা সিটির উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমন্বয় সাধনের জন্য তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন।
মেয়র প্রার্থীরা কী বললেন : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিটি গর্ভমেন্ট কনসেপ্ট নিয়ে আমাদের প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সমৃদ্ধ নগরী গড়তে এই ব্যবস্থাটি কার্যকর হতো। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে এককভাবে এই ব্যবস্থার প্রচলন করাতো যাবে না। দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশনে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হবে। তিনি বলেন, নগরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার ক্ষেত্রে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে কাজের জন্যে সুবিধা হবে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলে সিটি গর্ভমেন্ট ব্যবস্থা না থাকলেও সেই ব্যবস্থার সুবিধাগুলো কাজে লাগানো যায়। তিনি বলেন, চসিক মেয়রের সরকারি স্ট্যাটাসের উপরও সব স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়রে বিষয়টি কিছুটা নির্ভর করে। তবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সরকারি-আধা সরকারি-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় জরুরি।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়নের জন্য অবশ্যই সিটি গভর্নমেন্ট ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে। অন্যথায় যিনিই মেয়র হন না কেন এখানে কাজের গতি আসবে না। সমন্বয় নিশ্চিত করা যাবে না। পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়ন করা যাবে না। নির্বাচিত হলে সরকারের কাছে সিটি গর্ভমেন্ট ব্যবস্থা চালুর জন্য অনুরোধ করব। তিনি বলেন, সিটি গর্ভমেন্ট ব্যবস্থা না থাকলেও বিদ্যমান আইনের আলোকে অবশ্য কাজ করে যাব।