ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা বলতে জ্বর থাকলে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ানোর কথা বলছেন চিকিৎসকরা। আর রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রেখে তরল জাতীয় খাবারের পাশাপাশি নরমাল স্যালাইন দেয়ার প্রেসক্রাইব করে থাকেন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মাঝেও বিশেষ করে গরীব ও নিম্নবিত্ত পর্যায়ের রোগীরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নেন। তবে গরীবের চিকিৎসা সেবায় ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত এই হাসপাতালে বিনামূল্যের প্যারাসিটামল মিললেও নরমাল স্যালাইন পাচ্ছেন না ডেঙ্গু রোগীরা। বাইরের দোকান থেকেই এই স্যালাইন (নরমাল) কিনতে হচ্ছে রোগীদের। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের এমন একাধিক ওয়ার্ড সরেজমিনে ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কিছুটা সংকট থাকলেও হাসপাতালের স্টোরে নরমাল স্যালাইন রয়েছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। স্টোরে থাকার পরও ডেঙ্গু রোগীদের নরমাল স্যালাইন সরবরাহ না করার বিষয়ে খোঁজ–খবর নেয়ার কথা জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের তিনটি ওয়ার্ডে (ওয়ার্ড নং– ১৩, ১৪ ও ১৬) এবং শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের দুটি ওয়ার্ডে (৮ ও ৯) ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার করে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেডিসিনের ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখা যায়– ওয়ার্ডের মধ্যেই সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি বেড দেয়া হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের। বিছানার সাথে লাগোয়া মশারি থাকায় সহজেই এই রোগীদের (ডেঙ্গু) শনাক্ত করা যাচ্ছে। কম–বেশি সব রোগীর বেডের পাশে থাকা স্ট্যান্ডেই স্যালাইন ঝুলানো। বেশির ভাগের হাতেই স্যালাইন পুশ করার ক্যানুলা। তবে মশারির ভিতর থাকার কথা বলা হলেও অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীকে মশারি তুলে রাখতে দেখা যায়। রোগীরা মশারির ভিতর থাকছেন কী না, সে দিকে যেন কারও ভ্রুক্ষেপও নেই। যদিও কয়েকজন রোগীকে মশারির ভিতর দেখা গেছে।
১৬ নং ওয়ার্ডে চারদিন ধরে চিকিৎসাধীন এক রোগীর ভাই প্রান্ত’র সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের গ্রামের বাড়ি রাউজান। প্রান্ত জানায়– এখানে ভর্তির পর থেকে প্রতিদিনই স্যালাইন দিতে হচ্ছে রোগীকে। তবে একটি স্যালাইনও হাসপাতাল থেকে পাওয়া যায়নি। সবই বাইরের দোকান থেকে কিনতে হয়েছে। তবে জ্বর থাকলে প্যারাসিটামলটা হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে। একই কথা জানালেন চন্দনাইশ থেকে আসা আরেক রোগী। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর গত কয়েকদিন ধরে তিনি এখানে আছেন। প্রতিদিনই স্যালাইন দিতে হয়েছে তাকে। তবে তা বাইরের দোকান থেকে কিনে এনে। হাসপাতাল থেকে একটি স্যালাইনও পান নি।
১৩ ও ১৪ নং ওয়ার্ড ঘুরেও একই চিত্র পাওয়া যায়। ওয়ার্ড থেকে প্যারাসিটামল দেয়া হলেও স্যালাইন বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বলে জানালেন একাধিক রোগী।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবীরও প্রতিবেদকের সাথে ছিলেন। রোগীদের নরমাল স্যালাইন না পাওয়ার বিষয়টি তিনিও প্রত্যক্ষ করেন।
পরে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্স ও স্টাফদের কাছে নরমাল স্যালাইন সরবরাহ না করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তাদের কারও দাবি– হাসপাতালের স্টোরে চাহিদা দেয়া হলেও বেশ কয়দিন নরমাল স্যালাইন পাওয়া যায়নি। যার কারণে রোগীদের দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে কোনো কোনো ওয়ার্ডে স্যালাইন থাকলেও দায়িত্বরতদের অনেকেই তা জানেন না। ফলে রোগীদেরও সরবরাহ করা হচ্ছেনা।
এ বিষয়ে ওয়ার্ড থেকেই স্টোরে দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলেন সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবীর। এর মাধ্যমে ওয়ার্ড ও হাসপাতালের স্টোরে দায়িত্বরতদের সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর এ সমন্বয়হীনতার কারণেই হাসপাতালের রোগীরা বিনামূল্যের ওষুধ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
নরমাল স্যালাইনের কিছুটা সংকট থাকার কথা জানিয়ে ডা. হুমায়ুন কবীর বলেন,
আমাদের ডেক্সট্রোজ নরমাল স্যালাইন (ডিএনএস) পর্যাপ্ত আছে। তবে নরমাল স্যালাইন সংখ্যায় কিছুটা কম আছে। যা আছে তা দিয়ে কয়েকদিন চালানো যাবে। যার কারণে সাধারণ রোগীদের না দিয়ে হলেও অন্তত ডেঙ্গু রোগীদের যাতে নরমাল স্যালাইনটা নিশ্চিত করা হয়, সংশ্লিষ্টদের সে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি। এরপরও ডেঙ্গু রোগীরা নরমাল স্যালাইন না পাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবীর বলেন, রোববারের মধ্যেই পর্যাপ্ত নরমাল স্যালাইন হাসপাতালে পৌঁছে যাবে। তখন আর সমস্যা হবেনা।
জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, যার যা দায়িত্ব তা ভাগ করে দেয়া আছে। নিজের দায়িত্বটুকু আন্তরিকতার সাথে পালন করলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই দায়িত্ব এড়াতে চান। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কারো গাফেলতি পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।
উল্লেখ্য, এবার একটু আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে। গতবছর মধ্য আগষ্টে প্রকোপ দেখা দিলেও এবার তা শুরু হয়েছে জুনের আগেই। দিন দিন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে চট্টগ্রামে। এক মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। প্রকোপ শুরু হতে না হতেই ডেঙ্গুতে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগও বাড়াচ্ছে। চলতি বছর চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত মোট ১২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে তিন জনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে জুন মাসে (১৪ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে)। আর তিন জনের মৃত্যু হয়েছে চলতি জুলাইয়ের প্রথম চার দিনে। মৃতের তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই।
তবে আক্রান্তদের মাঝে শিশুদের মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। টানা কয়েকদিন ধরে পরপর মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। ডেঙ্গুতে পরপর এই মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এভাবে নিয়মিত মৃত্যুর ঘটনা ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রুপ নেয়ার আভাস দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সকলকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন সিভিল সার্জন। আর জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার।