নভেম্বর মাস শেষ হওয়ার পথে। দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টির দেখাও নেই। ভোরে টের পাওয়া যায় শীত এসেছে। এতসব পরিবর্তনের মধ্যে ডেঙ্গুর আক্রান্ত বাড়ার হারটাই একমাত্র অপরিবর্তিত রয়েছে।
কয়েক বছর আগেও জুলাই–আগস্টের পর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমতো। তবে গত বছর এবং চলতি বছর ডেঙ্গু ভাইরাসের চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। এখন অক্টোবর–নভেম্বর মাসে ডেঙ্গু বাড়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়ার সাথে বৃষ্টির যোগসূত্র রয়েছে। কারণ বৃষ্টিতে যত্রতত্র স্বচ্ছ পানি জমে। বিশেষ করে ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, বাড়ির আঙিনা বা ছাদে তিনদিনের বেশি জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হয়। এখন বৃষ্টি নাই, তারপরেও ডেঙ্গু ভাইরাসের চরিত্র বদলের বিষয়টি উদ্বেগজনক।
গতকাল চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছর এখন মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ২০৯ জন। এরমধ্যে জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৮ জন, মার্চে ২২ জন, এপ্রিলে ৩৩ জন, মে মাসে ১১৬ জন, জুনে ১৭৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩০ জন, আগস্টে ৭০৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৩৫ জন, অক্টোবরে ৯৯০ জন এবং নভেম্বরে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৭০৪ জন।
অন্যদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২ জন। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১ জন, এপ্রিলে ১ জন, জুলাইয়ে ৭ জন, আগস্টে ৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৪ জন, অক্টোবরে ১ জন এবং নভেম্বরে মারা গেছেন ২ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। দেরিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া এবং রোগীকে দেরিতে হাসপাতালে আনার কারণে অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর (এনএসওয়ান) পরীক্ষা করাতে হবে। এরপর ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে বাসায় পূর্ণ বিশ্রামে থেকে তরল জাতীয় খাবার (জুস, ডাবের পানি, স্যালাইন, স্যুপ) বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। জ্বরের জন্য শুধু সাধারণ প্যারাসিটামল খাবে। কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে জ্বর কমার পরের সময়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময়টাতে অতিরিক্ত দুর্বলতা, বমি, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র্যাশ, প্রস্রাব পায়খানায় বা অন্য কোনোভাবে রক্ত দেখা গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তবে অনেকে রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষায় প্লাটিলেট কমে গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। প্লাটিলেট কমলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্লাটিলেট কমলে রক্তক্ষরণ হবে এটি ঠিক নয়। এছাড়া ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্লাটিলেট কমে গেলে তাকে প্লাটিলেট দিতে হবে, এটিও গাইডলাইনে নেই। চিকিৎসাটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলেও রক্তক্ষরণ হয় না। আবার অনেকের প্লাটিলেট কাউন্ট বেশি থাকলেও রক্তক্ষরণ হয়।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম আজাদীকে বলেন, এই নভেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। তবে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। আমাদের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা সব সময় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করছি। আমরা যতই চিকিৎসা দিই না কেন, রোগীদেরও সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও কাজ করে যাচ্ছে।
এদিকে গত জুলাইয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ নগরীর চট্টেশ্বরী রোড (ওয়ার্ড ১৫), ওআর নিজাম রোড (ওয়ার্ড ১৫), আগ্রাবাদ (ওয়ার্ড ২৭), পাহাড়তলী (ওয়ার্ড ৯), হালিশহর (ওয়ার্ড ২৬), এবং ঝাউতলায় (ওয়ার্ড ১৩) এডিস মশা চিহ্নিতকরণে জরিপ চালায়। জরিপে ওইসব এলাকার ১২৮টি বাড়ির মধ্যে ৬২টিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন স্বাক্ষরিত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
উল্লেখ্য, গত বছর ২০২৪ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৩২৩ জন এবং মারা যান ৪৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৭ জন। এরমধ্যে মারা যায় ১০৭ জন। এছাড়া ২০২২ সালে মোট আক্রান্ত ৫ হাজার ৪৪৫ জনের মধ্যে মারা যান ৪১ জন এবং ২০২১ সালে আক্রান্ত হয় ২২১ জন এবং মারা যায় ৫ জন।












