নবোত্থিত জাতির স্বপ্ন-সম্ভাবনায় অভিঘাত

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | সোমবার , ১৫ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

কোনো বাঙালি, যে-কোনো মানুষ, যে-কোনো ব্যক্তি যাঁরা স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে জানেন এবং ৭৫’র হত্যাকাণ্ডের খবর রাখেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে মনের অজান্তেই চোখে জল আসে, মস্তক অবনমন হয়ে যায়। কেননা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এ বাড়িতেই নির্মমভাবে শহিদ হয়েছেন জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের মোট ১৮ জন। একইসঙ্গে নিহত হয় সদ্য-স্বাধীন দেশের বিচারবোধ। রুদ্ধ হয়ে পড়ে বাঙালি জাতির স্বপ্ন-সম্ভাবনা। কবি আসাদ চৌধুরীর ভাষায়- ‘হে ঘাতক তোমার সুবিশাল ছায়াতলে থেকে কেড়ে নিল তোমার নিঃশ্বাস/শিশুঘাতী, নারীঘাতী ঘাতকেরে যে করিবে ক্ষমা তার ক্ষমা নাই।’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করে যাবো।” তিনি তা করে গেছেন। কিন্তু তিনি আবার নতুন করে রক্ত ঋণের মধ্যে আবদ্ধ করে গেছেন। কেননা তাঁর রক্ত ধানমণ্ডির সিঁড়ি বেয়ে সারা বাংলায় লাল সবুজের প্রিয় মাতৃভূমি। এই ঋণ আমাদের বোঝা নয়, উত্তরাধিকার।

শ্রদ্ধা জানাই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নিহত সকলের প্রতি। ইতিহাস থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে। শুধু জাতির পিতা নয়, বাদ যাননি প্রিয়তমা স্ত্রী বঙ্গমাতা- শিশুপুত্র রাসেলও। অন্নদাশঙ্কর রায়ের “কাঁদো প্রিয় দেশ” কবিতার ভাষায়- “কাঁদো প্রিয় দেশ/কাঁদো মুক্তিদাতা মুজিবের জন্য/তাঁর সেই পরিচয়টাই ইতিহাসে অমর হবে/কাঁদো তাঁর সহমৃতা সাধ্বী সহধর্মিণীর জন্যেও/বালক পুত্রের জন্যেও/ কাঁদো,কাঁদো, প্রিয় দেশ…।”

বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালির জাতীয় পরিচয় সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি ধ্বংসস্তুপ পোড়ামাটির উপরে স্বপ্ন-সম্ভাবনার অমিতাভ সূর্য হয়ে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই রাষ্ট্রের কাঠামো এবং আইনকানুন সবকিছুই প্রস্তুত করেছিলেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের ভিত তৈরি করেছেন। খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করতে বিরাট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা ভুল প্রমাণ করে স্বল্প সময়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, অসাম্প্রদায়িক ও সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী তথা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অর্থবহ করতে দ্রুত ভারতীয় মিত্রবাহিনী প্রত্যাবর্তন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার, আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন, ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, কৃষক শ্রমিকের মর্যাদা বৃদ্ধিতে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্যাংক-বীমাজাতীয়করণ, ওআইসির সদস্যপদ লাভ, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান, জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাঙালিকে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।

খ্রিষ্টপূর্ব থেকে পৃথিবীতে বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বহু রাজা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, মহান নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে তাঁকে নির্বংশ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা দেখি ১১৭ খৃষ্টপূর্বাব্দে নমেডিয়ান হিমচাল প্রথম, ৪৪ খৃষ্টপূর্বাব্দে রোমের জুলিয়াস সিজার, বহু পরে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, বর্ণবাদবিরোধী নেতা মার্টিন লুথার কিং, ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, অং-সান (মন্ত্রিপরিষদসহ), প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতসহ অনেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু, তাঁরা সপরিবারে নিহত হননি। বঙ্গবন্ধুই পৃথিবীর একমাত্র নেতা যিনি সপরিবারে হত্যার শিকার হয়েছেন। স্ত্রী, শিশুপুত্র রাসেল, অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ, পুত্র, ভাই, ভাগিনা, আত্মীয়-স্বজনসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব সংকট তৈরির জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন জাতীয় চার নেতাকে জেলে বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

তবে, পারিবারিক কারণে জার্মর্ানিতে অবস্থান করায় ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যাকাণ্ড হতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহেনা বেঁচে যান। পরবর্তীতে শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নৃশংস গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি নির্মম আক্রোশ ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীরা শুধু জাতির পিতা, তাঁর পরিবার ও রাজনৈতিক সহযোগী হত্যার মধ্যে থেমে থাকেনি তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনাকেও মুছে ফেলার অপচেষ্টা শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড একটি বিকাশমান জাতির উন্মেষ ও নবযাত্রা রুদ্ধ করে দেয়। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলার রূপ হয়ে যায় অন্ধকারাছন্ন, বেপথু। ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে উল্টো দিকে। বস্তুত, ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক নেতাদের পরিণতি হয়ে থাকে এটাই! কেননা জনসভায় বঙ্গবন্ধু একাধিকবার বলেছিলেন “আমার অবস্থা যদি চিলির আলেন্দের মতোও হয় আমি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মাথা নত করব না।” চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে এক অভ্যূত্থানে ১৯৭৩ সালে নিহত হন। জেনারেল অগুস্তো পিনোশের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এক রাতে প্রেসিডেন্টের লা মোনেদা প্রাসাদে আক্রমণ চালিয়ে আলেন্দেকে হত্যা করে। তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় একজন স্যোসালিস্ট নেতা। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত, শোষিত আর শাসিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন ঐদিনই বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছিলেন। কেননা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল দেশি ও বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কী হলো? বাংলাদেশের ভিত্তির যে চারটি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মৌল পরিবর্তন করা হলো। দেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর কার্যক্রম শুরু হলো। এমনকি ৭৫’র হত্যাকাণ্ডে জড়িত ঘাতকদের দায়মুক্তি (রহফবসহরঃু) আইনে বিচার থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু খুনিদের যাবতীয় অপচেষ্টা গুঁড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে পিতার আরাধ্য স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু করেন। একসময় বাংলাদেশ মানেই ছিল বঙ্গবন্ধু। আজ শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সমার্থক হয়ে গেছে। জনমানুষের নেতা শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বে বাংলাদেশকে পরিণত করেছেন মধ্যম আয়ের দেশে। আজকের সম্ভাবনার বাংলাদেশ স্বল্প আয় থেকে মধ্যম আয় এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে প্রবেশ করছে। শেখ হাসিনা বহুবার উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু আর কিছুদিন বেঁেচ থাকলে এ লক্ষ্যে আরো আগেই পৌঁছে যেতেন। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা দিন বদলের সনদ ঘোষণা করেছিলেন। এই সনদ বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির চাবিকাঠি। তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়া এখন আর কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। নিশ্চিতভাবে আশা করা যায় ২০৪১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিণত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।

মাতা-পিতা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন হারানোর দগদগে দুঃখ বুকে ধারণ করে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা যেন এক পরশ পাথরে পরিণত হয়েছেন। নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমার জীবন এখন উদ্বৃত্ত জীবন। ৭৫’ সালে ধানমণ্ডির বাসভবনে থাকলে আমিও ঘাতকের হাতে জীবন দিতাম।” এই চেতনায় শাণিত শেখ হাসিনা আজ সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের দায়িত্ব নিয়েছেন। পিতার স্বপ্নকেই তিনি যেন বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু একবার ভাষণে বলেছিলেন, “স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।” বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শের সার্থক উত্তরসূরী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে জিডিপি। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, কমেছে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার।

বঙ্গবন্ধু এখন শুধু বাঙালির নন, তিনি বিশ্বসভার। তাঁর ত্যাগ, কর্ম ও জীবন দর্শন পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। কয়েকজন খুনি ও কয়েকটি বুলেট তাঁর হৃদস্পন্দন স্তব্ধ করতে পারলেও তিনি লাখো মানুষের, বাংলার প্রতিদিনের সূর্য ও পদ্মা-মেঘনা-যমুনার প্রবহমান স্রোত হয়ে চিরঞ্জীব। বাংলাদেশ নামে যাঁর আস্থা, বাংলাদেশের হৃদয়ে যাঁর বিশ্বাস, যে মানুষের হৃদয়ে দাসত্ব নেই, যাঁর উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা নেই, সেই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে। আমরা চাই বা না চাই ইতিহাসের চিরায়ত নিয়মেই তাঁকে কুর্ণিশ করতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়াবার সময় সে পতাকার মধ্যখানে এক বন্ধুর নাম থাকে, সে বন্ধুর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা বলেছিলেন সেই বাণী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও সত্য- “যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে/ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে/দেশের মাটি থেকে নিল যারে হরি/দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।”

লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
পরবর্তী নিবন্ধশোকে শক্তি, জাগরণের মহাশক্তি শেখ হাসিনাতে অদম্য বাংলাদেশ