চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানার একটি প্রতারণা মামলার আসামি নবিজ উদ্দিন। উচ্চ আদালত থেকে তিনি ৬ সপ্তাহের জামিন পান। জামিনের শর্ত ছিল, জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির হতে হবে। উচ্চ আদালতের সেই শর্ত নবিজ মানেননি। তিনি আদালতে হাজির না হয়ে পলাতক হন। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত কর্তৃক তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু হয়। সেই পরোয়ানামূলে নবিজকে গ্রেপ্তার করে কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানা পুলিশ।
কুড়িগ্রামের আদালতে হাজির করা হলে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির হওয়ার শর্তে তার জামিন মঞ্জুর করা হয়। আদালত সময়ও বেঁধে দেয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নবিজ চট্টগ্রাম আদালতে হাজির হননি। দীর্ঘদিন পর গত ১১ ডিসেম্বর নবিজ সেজে চট্টগ্রাম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আজির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। আদালতও নবিজ ভেবে আজির উদ্দিনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। ৪৭ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। পরে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এ ঘটনা ধরা পড়ে। কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে বিষয়টি অবহিত করে।
স্পর্শকাতর এ ঘটনায় আজির উদ্দিনসহ দুজনের বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার দণ্ডবিধির ২০৫/৪৬৬/৩৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার অপর আসামি হলেন মো. নাজমুল হোসেন। চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হক বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। এ সময় আদালত কক্ষে নকল আসামি আজির উদ্দিন হাজির ছিলেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতের বেঞ্চ সহকারী নূরে খোদা আজাদীকে বলেন, নবিজ সেজে আদালতে আজির নামের যুবকের আত্মসমর্পণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি গ্রহণ করে আদালত আজিরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এছাড়া মামলার অপর আসামি মো. নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
আদালত সূত্র জানায়, মামলা দায়েরের আগে পিডব্লিউ মূলে আজিরকে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হক তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। সেই জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি নারায়ণগঞ্জে রোলিং মিলে চাকরি করতেন। মো. নাজমুল হোসেন (নবিজের ভাই) তাকে চট্টগ্রামের আদালতে নিয়ে আসেন এবং একটু কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেন। উকিলের কথা শেষ হলে সেখান থেকে নিয়ে যাবেন বলে জানানো হয়। কিন্তু সেটি হয়নি। পুলিশ তাকে ধরে রাখে এবং হ্যান্ডকাপ পরানো হয়।
চাকরি পাওয়ার লোভে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন উল্লেখ করে আজির উদ্দিন জানান, নাজমুল হোসেন ও তিনি একই এলাকার বাসিন্দা। তার নাম নবিজ উদ্দিন নয়। আদালতজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়া এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আরজিতে বলা হয়, আসামি মো. নাজমুল হোসেন জোরারগঞ্জ থানার জিআর ১৩৫/২৩ ইং মামলার এজাহারনামীয় ও চার্জশিটভুক্ত আসামি। আর আজির উদ্দিন জোরারগঞ্জ থানার উক্ত জিআর ১৩৫/২০২৩ ইং মামলার মিথ্যা পরিচয়ে আত্মসমপর্ণকারী ব্যক্তি। মামলাটি দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/১০৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ এবং প্রতারণার মামলা। মামলার ২ ও ৩ নং আসামি যথাক্রমে মো. নাজমুল হোসেন ও মো. নবিজ উদ্দিন উচ্চ আদালত থেকে ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর ৬ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। তাদেরকে জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চট্টগ্রামের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে আত্মসর্মপণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন না করায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ইতিমধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আদালতে উক্ত চার্জশিট গৃহীত হয়। এরই প্রেক্ষিতে আসামি নবিজ উদ্দিন গত ৪ মার্চ ওয়ারেন্টমূলে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট থানা কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। তাকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তার পক্ষে জামিন আবেদন করা হলে চট্টগ্রামের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৫ মার্চের মধ্যে হাজির হবার শর্তে তার জামিন মঞ্জুর করা হয়।
মামলার আরজিতে বলা হয়, শর্ত অনুযায়ী আসামি নবিজ উদ্দিন ২৫ মার্চ আদালতে হাজির হননি। পরবর্তীতে ১১ ডিসেম্বর জামিনে গিয়ে পলাতক উক্ত আসামি মো. নবিজ উদ্দিন স্বেচ্ছায় আদালতে হাজির হয়ে জামিনের প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে বিচারক জামিন আবেদনটি নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। জামিন আবেদনের সময় তিনি আইনজীবী টি আর খান তাহিম কর্তৃক টিসি বা ট্রু কপি বলে সত্যায়িত জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করেন, এই মামলার আত্মসমর্পণকৃত আসামি নবিজ উদ্দিন ভুল নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) ডেটাবেসে এন্ট্রি দেওয়ার সময় দেখা যায়, এই আসামির নাম মো. আজির উদ্দিন। তার পিতার নাম ছলিম উদ্দিন। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট থানার বালাপাড়া এলাকায় তার বাড়ি। কিন্তু জামিন আবেদনে তিনি নিজেকে নবিজ উদ্দিন পরিচয় দেন। নবিজ উদ্দিন হচ্ছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানার মধ্যম খিতাব খান বটতলা এলাকার বাসিন্দা। তার পিতার নাম মো. আয়ুব আলী।