ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য নিয়ে পালাক্রমে ছয়টি ঋতু ঘুরে ফিরে আমাদের প্রকৃতিকে ফিরে আসে বারবার। প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র বা আলাদা আলাদা সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। ঋতু বদলের সাথে সাথে যেন প্রকৃতির সাজও বদলে যায়। এদেশের মানুষ মাত্রই সচেতনভাবে সে পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারেন। ঋতুতে ঋতুতে প্রকৃতির এই সাজ বদল আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে যোগ করেছে নানা উৎসব। আর উৎসব এই চলে আসছে আবহমান বাংলায় হাজার বছর ধরে। উৎসবের সাথে প্রকৃতির এই মেলবন্ধন যেন শাশ্বত ও চিরকালীন। এই সাজ বদলের পালায় বাংলাদেশের প্রকৃতি আরো সজীব বৈচিত্র্য ও প্রাণময় হয়ে ওঠে। এমন অপরূপ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি পৃথিবীর আর খুব কম দেশেই দেখা যায়। বাংলা বারোটি মাসের কার্তিক–অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। হেমন্তকে বলা হয় ফসলের ঋতু। মাঠে–ঘাটে থাকে শস্যের সমারোহ হেমন্ত যেন এক অনিন্দ্য সুন্দর বার্তা বহন করে। তাই তো রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি।’ সত্যি ক্ষেতের মধুর হাসি যেন অনবদ্য সৌন্দর্যে আমাদের মনপ্রাণকে ভরিয়ে তোলে। তাই আবহমান এই বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের তুলনা মেলে না। গ্রাম বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ হলুদ বর্ণময়। পাকা ধান আর হলুদ রঙের শর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের বুক। হলুদ বর্ণের সোনালি পাকা ধানে মাঠ থাকে ভরা। পাকা ধানের মনমাতানো গন্ধে বাতাসে প্রকৃতি হয় মাতোয়ারা। কৃষক বধূরও মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। ফসলের হাসি আর কৃষকের হাসি যেন এক হয়ে খুশির বন্যা ছড়িয়ে দেয় চারিদিক। ধানের সবুজ ক্ষেত ধীরে ধীরে হলুদ বর্ণ ধারণ করলেই কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফসল কাটার কাজে। ধানে কেটে কৃষক আনন্দে উদ্বেলিত হয়, সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, কৃষকের মুখে মুখে ফোটে অনাবিল আনন্দের হাসি । এই হাসিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে শুরু হয় হেমন্তে নবান্নের উৎসব। নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রাম–বাংলার জনপদ। হেমন্ত আসে ঠিকই নীরবে; কিন্তু প্রকৃতির নবান্ন উৎসব জানান দেয় হেমন্তের অস্তিত্ব। একসময় গ্রাম বাংলায় হেমন্তের নবান্ন উৎসব ছিল প্রতিবছরে পালিত নির্দিষ্ট একটি উৎসব। কিন্তু গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের হারিয়ে যাবার কিছু গ্রামীণ অনুষঙ্গের মধ্যে নবান্নও আজ সেই কাতারে। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির এ যুগেও আমাদের গ্রামীণ আবহমান বাংলার নবান্ন কিন্তু সেভাবে পালিত না হলেও ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসাবে এখনো সমুজ্জ্বল। ব্যাপকভাবে তার কার্যক্রম এখন আর দৃশ্যমান না হলেও দেশের অনেক জায়গায় গ্রামে গঞ্জে কিংবা শহরের কোথাও কোথাও নবান্ন উৎসব মহাসমারোহে পালিত হবার খবর পাওয়া যায়। বাংলা নববর্ষের মত নবান্নও এদেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে দেদীপ্যমান একটি নাম। আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছে নবান্ন নামটি খুবই অপরিচিত একটি নাম, কেউ কেউ হয়তো সেটার আনুষ্ঠানিকতা কী– সেটা জানেও না। আবার কেউ কেউ এটা সম্পর্কে পাঠ্য পুস্তকে পড়ে সামান্য ধারণা লাভ করলেও তা বাস্তবে কী কেউ হয়তো দেখেনি। তাই শহরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নানা আনুষ্ঠানিকতায় যে নবান্ন উৎসব পালিত হয়, তা থেকে এ প্রজন্মের অনেকেই কিছুটা ধারণা পেতে পারে। এভাবেই তারা পরিচিত হতে পারে আমাদের আবহমান বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের সাথে। সেজন্য এভাবে নবান্ন উৎসব পালনের গুরুত্বও রয়েছে। নবান্ন হচ্ছে একান্তভাবে গ্রাম বাংলার উৎসব। খোদ গ্রাম বাংলার অনেকের ঘরে এ উৎসবের কথা অনেকেই জানেন না। একসময় গ্রামের বাড়ির উঠোনে উঠোনে ধান মাড়াই হতো। গরু দিয়ে ধান মাড়াই করে গোলায় ধান তোলা হতো। এখন প্রযুক্তির কাছে সব কিছু চাপা পড়ে গেছে। নবান্নের শব্দগত অর্থ সেটা হচ্ছে নতুন অন্ন অর্থাৎ নতুন খাবার । নতুন ধানের চাল দিয়ে এই নতুন খাবার তৈরি হয়। গ্রামবাংলার উৎসবের বর্ষপঞ্জির শুরুটা হয় এই নবান্ন দিয়েই। আর সমাপ্তি ঘটে চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে। অগ্রহায়ণ মাস আর নবান্ন যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি শব্দ। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটিই বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব উদযাপনের দিন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম। নতুন আমন ধান কাটার পর সে ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করা হয় বলে এর নাম নবান্ন। এটি আমাদের গ্রাম বাংলার শস্যভিত্তিক একটি লোকজ উৎসব। কৃষিভিত্তিক এই বাংলায় শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে এ নবান্ন উৎসব পালিত হয় বলে এর অনেক তাৎপর্য রয়েছে। নবান্ন নিয়ে এ গ্রাম বাংলায় প্রচলিত আছে অনেক আচার অনুষ্ঠান। দেশের অনেক জেলায় জামাইকে নিমন্ত্রণ এবং নতুন চালের পিঠা পায়েস মুড়ি মুড়কিসহ নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে এক সময় মেয়েদের বাপের বাড়িতে নাইয়র আনা হতো এবং জামাই মেলাও বসতো। পাড়ায় পাড়ায় হতো নবান্ন উৎসব। গ্রামের ঐতিহ্য ঢেঁকিতে ধান ভাঙা হতো এবং সাথে চলতো ধান ভাঙার গান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘরের দেয়ালে ফুল পাখি লতাপাতাসহ নানা ধরনের রঙের চিত্র এঁকে বাড়িকে চমৎকার সাজে সজ্জিত করা হতো।
নবান্ন উৎসবে বিভিন্ন অঞ্চলে জারি সারি মুর্শিদি হাসন লালনের গানের বসতো। নাগরদোলা পুতুলনাচ, বায়োস্কোপের আসর বসে শিশুকিশোরদের মনকে রাঙিয়ে দিতো। অনেকের কাছে এগুলো যেন এখন গল্পের মতো। এখন এসব শুধুই ইতিহাস। সমপ্রীতি ঐক্য ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ এই নবান্ন যেন অসামপ্রদায়িক এক ঐতিহ্যেরই অংশ। দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে নবান্ন ঘিরে এসবের এখনো দেখা মেলে। এই নবান্ন আমাদের শিল্পী সাহিত্যিকদের মনকেও নানাভাবে রাঙিয়ে দিয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এ কার্তিকের নবান্নের দেশে।’ বর্তমান বাস্তবতায় মহাসমারোহে নবান্ন উৎসব পালন গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় নেই বললেই চলে। জেলা শহরের কোথাও কোথাও নবান্ন নিয়ে যে অনুষ্ঠান হয় তা সকলের নিকট এই নবান্নের সর্বজনীন বার্তা পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তৃণমূলের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় ও শহর–নগরে নানা অনুষ্ঠানমালায় এই নবান্ন উৎসব প্রতি বছর সমারোহে পালিত না হলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত উৎসবের কাতারে নবান্নও জায়গা নিতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; কলেজ শিক্ষক।