আসছে বাংলা নববর্ষ! বাঙালির একমাত্র সেকুলার উৎসব! সর্বজনীন প্রাণের উৎসব! কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন গোত্রের। একে করোনার করাল গ্রাস, তার সাথে যুক্ত হচ্ছে লকডাউনের কাঁটাতার। এদিন অথবা পরের দিনেই পবিত্র রমজানের প্রথমদিন। এখানেই সবচে ভয় ধর্মান্ধ আস্ফালনকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং তৎপরবর্তী কয়েকদিনের হাটাহাজারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়াণগঞ্জ ও ঢাকার ধ্বংসচিত্র অবলোকন করলে শংকায় বুক কাঁপে না এমন বাঙালি কই!
অথচ বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। এ ইতিহাস শ্বেতশ্মশ্রু মহীরুহ প্রায়! হাজার বছর ধরেই বাংলার এ উৎসব, ক্ষেত্র জাতি গোষ্ঠী পরিবার ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নভিন্ন আচার আচরণের মধ্য দিয়ে উদযাপন হয়ে আসছে। বর্তমানে আমরা যে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বসবাস করছি এই রাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ জনপদ মূলত গ্রামীণসভ্যতা হিসাবে বিস্তৃতি লাভ করা শুরু করে মৌর্যযুগে এবং মোগল আমলে তা স্থায়ী ভিত পায়। তখন নিম্নবাংলার চাষাভূষা প্রান্তজন উৎপাদিত ফসলের অংশ কিংবা নগদ কড়িতে রাজাকে কিংবা রাজপ্রতিনিধিকে খাজনা প্রদান করার মধ্য দিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করতো, রাজা কিংবা রাজপ্রতিনিধি সেই খাজনা গ্রহণপূর্বক দায়িত্ব সম্পাদন করতেন। রাজা এবং প্রজার সম্পর্কের প্রধান ভিত ছিল খাজনা। প্রান্তীয় কৃষক বছরের নির্দিষ্ট সময়ে রাজা, রাজপ্রতিনিধি, মহাজন, বেনিয়াদেরকে টাকা পরিশোধের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো, সে সময় এই নববর্ষ উদযাপন হালখাতা বা পুণ্যাহ উৎসব হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। শত শত বছর ধরে গ্রামীণ জনপদে এ সংস্কৃতি স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানকে আত্মস্থ করে ক্রমশ শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। যেমন কলাগাছ, ফুল, আম্রপল্লব, কাগজের মালা, নিমন্ত্রনপত্র, মিষ্টিমুখ, উপহার দেয়ানেয়া ইত্যাদি। কিন্তু ৭০দশক হতে ধীরে ধীরে ব্যাংক ব্যবস্থার ন্যায় প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের বিস্তৃতি, অপ্রাতিষ্ঠানিক মহাজনী ব্যবস্থা দুর্বল হওয়া, এনজিও প্রসার, কৃষি বহির্ভূত জীবিকার বিস্তৃতি, নগরের বিকাশ, মধ্যপ্রাচ্যে অভিগমন ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের সাথেসাথে গ্রামীণ পটভূমির হালখাতা বা পুণ্যাহ ক্রমশ নিস্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। নগরায়ণের ক্রমবিস্তৃতিতে নাগরিক আগ্রাসনে একটা নতুন ধরণের নববর্ষ ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে। ৮০ দশকের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা থেকে শুরু হওয়া মঙ্গলশোভাযাত্রা এই নাগরিক নববর্ষে নতুন মাত্রা দান করে। যদিও পাকিস্তান আমল থেকেই ছায়ানটের বটমূল কেন্দ্রিক এ অনুষ্ঠান নবোত্থিত বাঙালি মধ্যবিত্তের সেকুলার চেতনাকে জাগরুক রেখেছিল।
মঙ্গলশোভাযাত্রা তৎকালীন সময়ে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে গতি দিয়েছিল এবং ঠিক সে সময়েই সরকার দীর্ঘদিনের প্রচলিত বাংলাপঞ্জিকার স্থলে গ্রেগ্ররিয়ান ক্যালেন্ডারকে ভিত্তি করে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করেন। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচলিত পঞ্জিকা মোতাবেক হালখাতা তারিখ চালু থাকলেও, সরকারি নববর্ষ পালন ভিন্ন হয়। ৯০দশক থেকে দেশে বহুজাতিক কোম্পানী ও বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে নববর্ষ, ব্যবসা বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিজ্ঞাপন, বিপণন ও প্রচারের বিচিত্র মহিমায়, প্রথাগত মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলে।
পশ্চিমা সভ্যতায় গণউৎসব সমূহে নারী পুরুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ সমাজের সেকুলার চরিত্রকে প্রতিভাত করেছে। বাংলা নববর্ষও বাংলাদেশ সমাজে একই ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মঙ্গলশোভাযাত্রা সহ নববর্ষ-কেন্দ্রিক বিবিধ অনুষ্ঠানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নাগরিক নারীদের সংস্কৃতির মূলস্রোতে সংযুক্ত করেছে। এমনকি রক্ষণশীল মুসলিম নারীমানসেও নাগরিক নববর্ষ উদযাপন একটা নতুন ঢেউ সৃষ্টি করেছে। অন্তত এই একটি দিন সবাই লোকজ সাজে বাইরে আসার সুযোগ খুঁজে পায়। ইতোমধ্যে ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সব বড় শহরেই বিশেষত যুবাদের মধ্যে নববর্ষকে কেন্দ্র করে নতুনপোশাক ও আনুসঙ্গিক সামগ্রী উপভোগের যে প্রবণতা তা হতে বৈশাখীমেলা গ্রামীণ রূপ ছেড়ে নাগরিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির মূলস্রোতে নারীদের এই ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ বাংলাদেশের উগ্রমতাদর্শী ও মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্ষুশূল হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। তাই উগ্রবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মঙ্গলশোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আস্ফালন মূলত নারীকে পুনঃগৃহবন্দি করার বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যুগে যুগে উগ্রবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা নারীকে চঁনষরপ ঝঢ়যবৎব থেকে বহুদূরে চৎরাধঃব ঝঢ়যবৎব’এ সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। বাংলা নববর্ষ বাঙালি নারীকে চৎরাধঃব ঝঢ়যবৎব এর লক্ষণরেখা ছাড়িয়ে চঁনষরপ ঝঢ়যবৎব এর গতিময়তা দিয়েছে। আসলে এটাই একমাত্র অনুষ্ঠান যেখানে জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। এর কোন সামপ্রদায়িক চরিত্র নেই, এর কোনো জাত নেই, এর কোনো ব্যবধান নেই। এটাই একমাত্র উৎসব যা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। এটাও উগ্রবাদীদের অন্তর্দহনের অন্যতম কারণ। ঐতিহাসিকভাবে, মোগল শাসকরা খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরিসনের পরিবর্তে বাংলাসন প্রবর্তন করেন। তৎকালীন ধর্মীয় আলেম-ওলেমাগণ এবং উগ্রপন্থী প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে সম্রাট আকবর গণমানুষের জীবনধারাকে বাংলা নববর্ষের মধ্য দিয়ে ধারণ করার চেষ্টা করেন। হিজরি নববর্ষের চান্দ্রমাসের সংখ্যাতাত্ত্বিক দুর্বলতাকে অতিক্রম করে সৌরগণনা অনুযায়ী প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষ একটা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করে। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলাদেশে সর্বজনীন নববর্ষ উদযাপনই কাম্য।
লেখক : কবি