তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে আবার আমাদের দুয়ারে এলো পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা / অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা—’ এই মঙ্গল আহ্বান নিয়ে কালের পরিক্রমায়, বাঙালিদের নিজস্ব উৎসব নববর্ষ সমাগত। রবীন্দ্রনাথের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদের প্রাণের গভীরে ধ্বনিত হয়-
তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো,/ নির্বাণহীন নির্মল আলো/ অন্তরে থাক জাগি।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। জাত -বর্ণ-ধর্ম, ধনী-গরীব নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি মানুষ এই উৎসবের রঙে মন-প্রাণ ভরিয়ে তোলে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিবাসীরাও বৈসাবি’র মাধ্যমে নতুন বছরকে আবাহন করে।
মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সাধারণ কৃষকদের চাষাবাদের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর ‘ইলাহিঅব্দ’ নামে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। কেননা মোগল আমলে খাজনা আদায় করা হতো চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। কিন্তু কৃষক জমির ফসল ঘরে তুলতে পারতো নির্দিষ্ট সময় পর পর। চান্দ্রবর্ষ প্রতি বছর ১১ দিন এগিয়ে যেত। যার কারণে কৃষকদের খাজনা দেওয়া ও ফসল তোলার মধ্যে সমস্যা তৈরি করতো। সম্রাট আকবর সহজ বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে বছরের হিসাব রাখার প্রয়োজনে একটি নতুন সন উদ্ভাবনের জন্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে দায়িত্ব দিলেন। শিরাজী ‘ইলাহি সন’ নামে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি আবিষ্কার করলেন। সেসময়ের কৃষক শ্রেণি এটি ‘ফসলি সন’ নামে অভিহিত করলেও, কালক্রমে এটি ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়।
ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাট আকবরের আমল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। এই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ হাজার বছরের গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সমাজের সম্পূর্ণ নিজস্ব আচার। সেই মধ্যযুগের চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমিমালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই দিনের প্রধান অনুসঙ্গ হলো হালখাতা তৈরি করা। যা এখনও বিদ্যমান।
পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ সম্পূর্ণ গ্রামীণ উৎসব। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা-সঞ্জাত এই আমজনতার আচার অনুষ্ঠানের নাগরিক জীবনে প্রবেশ ১০০ বছরের আগে নয়। ১৯১৭ সাল থেকে কলকাতা ও ঢাকায় নববর্ষ উদযাপনের তথ্য পাওয়া যায়।
পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে আত্মীকৃত। এটি একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপলক্ষ হলেও, এর রাজনীতিকরণ শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশক থেকে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো – ষাটের দশক হলো বাংলা ও বাঙালির সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অগ্নিগর্ভ সময়। দেশ তখন আইয়ুব শাহী সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট। দেশের মানুষ নিগৃহীত। বাঙালিত্ব থেকে বাঙালিকে বিচ্যুত করার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। এমতাবস্থায় ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। আর এই ছায়ানটের উদ্যোগেই রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু ১৯৬৭ সালে। রমনা পার্কের বিশাল মঞ্চে সারিবদ্ধভাবে বসে সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয় সংগীত। দর্শকদের মধ্যে নারীরা পরিধান করে লাল কাপড়ের সাদা শাড়ি এবং পুরুষেরা সাদা পাঞ্জাবি।
নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ও বাস্তবতা পেছনে ফেলে সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষ নববর্ষ উদযাপনে মেতে ওঠে। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় নতুন আর একটি উৎসব অনুষঙ্গ। তা হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। লক্ষণীয় বিষয় হলো তখন ছিলো এরশাদীয় অপশাসন। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সকল অপসংস্কৃতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলো এক জোরালো প্রতিবাদ।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। পক্ষান্তরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্যকলা ও বলীখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান। গ্রামীণ জীবনে আয়োজন করা হয় মেলা ও নৌকা বাইচ। মেলায় গ্রামীণ বাংলার পাট শিল্পীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেন। ব্যবহারিক তৈজসপত্র থেকে শুরু করে বাঁশ-বেত শিল্পের সম্ভার, শখের হাড়ি, মোয়া-মোড়কি, গজা-হাওয়াই মিঠাই, পাতার বাঁশি, তালপাখা- আরো কত কী !
বছরের ১ম দিন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের গ্রামীণ জীবনে নেই। কখনো ছিলও না। নাগরিক সংস্কৃতির অতি আধুনিক নবায়নই পান্তা-ইলিশের ক্যারিকেচার!
সম্রাট আকবর থেকে শুরু, মধ্যখানে রাজা রামমোহন রায় ও ডিরোজিও বিবর্তিত বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে উৎকর্ষিত হলো। যা বুদ্ধির মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিকশিত হয়েছিল। বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে নববর্ষ উৎসব একান্ত বাঙালির। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এদেশের মুক্তিযুদ্ধ হলো হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,খিষ্ট্রান ও সকল জাতিগোষ্ঠীর অধিকার এবং সংস্কৃতি ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এখনো তুচ্ছ কিছু নন- ইস্যুকে ইস্যু করে একটি সংঘবদ্ধ অশুভ চক্র দেশকে অস্থির করার ব্রত নিয়ে এগোচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহে এটি প্রমাণিত। তাই নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার পথে সকল অমঙ্গলকে দূরীভুত করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষায় মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি। নববর্ষের পথেই নবযাত্রায় পথচলি।
তো, ফি বছর বৈশাখ আসে, বৈশাখ যায়। নববর্ষ আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি। যা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। বাঙালির আত্মপরিচয়ের শেকড়। এই বৈশাখ আমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক-
এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, সভাপতি, বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগ ও অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।