নন্দীগ্রামে মমতার নাটকীয় হার, মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন?

পশ্চিমবঙ্গে আবার তৃণমূল

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ৩ মে, ২০২১ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বুথফেরত জরিপ বা জনমত জরিপ সব ক্ষেত্রেই আভাস মিলছিল পশ্চিমবঙ্গে ফের সরকার গড়তে যাচ্ছে মমতার তৃণমূল। অপেক্ষা ছিল গতকাল রোববার ভোট গণনার দিনের। যদিও বিজেপি বারবার বলে যাচ্ছিল, দিদিকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পতাকা উড়াবে তারা। কিন্তু দলটির সে স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিল না। এ নিয়ে পরপর তিনবার, হ্যাট্রিক করলেন মমতা। আনন্দবাজার লিখেছে, উঠে দাঁড়ালেন, যেমন দাঁড়াতেন। চলাফেরায় সেই দৃপ্ত ভঙ্গিমা। চেনা সেই ক্ষিপ্রতা। বায়ান্ন দিন পর তাকে হাঁটতে দেখল গোটা দেশ। দীর্ঘ এই সময়ের সঙ্গী হুইলচেয়ার ছেড়ে এমন মুহূর্তে মমতা হেঁটে সামনে এলেন, যখন নীলবাড়ির লড়াইয়ে তিনিই জয়ী।
গতকাল সকাল থেকে ভোট গণনার ফল আসতে শুরু করে। এতে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে নিরঙ্কুশ জয়ের পথে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। যদিও অনেক নাটকীয়তার পর নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর কাছে হেরে গেছেন তিনি।
গতকাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে দুটির ভোটগ্রহণ প্রার্থীর মৃত্যুতে স্থগিত রয়েছে। ২৯২ আসনের মধ্যে মমতার তৃণমূল ২১৫ আসনে এগিয়ে আছে। বিজেপি এগিয়ে আছে ৭৬ আসনে। রাজ্যে বামেরা কোনো আসন পাচ্ছে না।
আসন প্রাপ্তির নিরিখে তো বটেই ভোটপ্রাপ্তির নিরিখেও সেরা ফল করল তৃণমূল। শতাংশের হিসেবে এটাই মমতার প্রতিষ্ঠিত দলের সবচেয়ে ভালো ফল। ভোটগণনার গতিপ্রকৃতির ইঙ্গিত, মোটের উপর ৪৮ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে তৃণমূল। অতীতে কোনো বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে এত আসন পায়নি তারা। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৬টি লোকসভা এবং ৫টি বিধানসভা ভোটে লড়েছে তৃণমূল। বিধানসভা ভোটের নিরিখে এ পর্যন্ত সেরা ফল হয়েছিল ২০১৬ সালে। ৪৪.৯১ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১টি আসনে জিতেছিল জোড়াফুল। ভোট শতাংশের পাশাপাশি আসন প্রাপ্তির হিসেবেও এবার সেই সংখ্যা ছাপিয়ে গেল তারা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বে অনুষ্ঠিত হয় বিধানসভার ভোট। ভোটের সময় নির্বাচনী সহিংসতায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
দিদিকে অভিনন্দন মোদীর : টানা তৃতীয়বারের মতো জিততে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। আনুষ্ঠানিক ফলাফল এখনো ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে এক টুইটে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবার পশ্চিমবঙ্গের দখল নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল মোদীর দল বিজেপি। মোদী নিজে সেখানে দলের নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় ছিলেন। দলীয় প্রচারের জন্য কয়েকবার তিনি পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণও করেছেন।
মোদী-মমতার কথার লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। দুই নেতা পরষ্পরকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। পশ্চিমবঙ্গের সমাবেশগুলোতে ‘দিদি’ ‘ও দিদি’ বলে মমতাকে বহুবার ব্যঙ্গ করেছেন মোদী। এবারও সেই ‘দিদি’ ডেকে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
বিজেপিতে ক্ষোভ : পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটে বাংলা দখলের লড়াইয়ে কার্যত বিপর্যয় হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। এমন পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতাদের একাংশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের নাম না নিলেও রাজ্যের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, যারা সেনাপতি হয়েছিলেন, জিতলে তারা কৃতিত্ব নিতেন। তাদেরকে এখন হারের দায়ও নিতে হবে।
এবারের নির্বাচনে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কেবল হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকে ভোট দেয়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো হিন্দু বাঙালিরা এবার বিজেপিকে ভোট দিলে দলটি অনেকটাই এগিয়ে থাকত।
নন্দীগ্রাম নাটকের শেষ অংকে শুভেন্দুর জয় : নির্বাচনে আলোচিত নন্দীগ্রাম আসনে ভোটের ফল নিয়ে কয়েক ঘণ্টার চরম নাটকীয়তা শেষে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। অথচ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম খবর এসেছিল এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে এক হাজার ২০১ ভোটে জিতেছেন তৃণমূল নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওই খবর প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনে নন্দীগ্রামে নিজেকে বিজয়ী দাবি করেন এক সময় মমতার ‘লেফটেনেন্ট’ হিসেবে পরিচিত শুভেন্দু। তিনি তৃণমূল ছেড়ে এবারই প্রথম পদ্মফুল (বিজেপি) নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন। দুই ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীর জয় দাবির প্রেক্ষিতে সন্ধ্যা থেকেই নন্দীগ্রাম আসনের ফল নিয়ে নাটকীয়তা শুরু হয়।
একদিকে নির্বাচন কমিশন ভোট পুনঃগণনা করবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মমতা সাফ জানিয়ে দেন, নন্দীগ্রামের মানুষ যে রায়ই দিক তিনি তা মেনে নেবেন। একই সঙ্গে তিনি নন্দীগ্রামে ভোট লুটের অভিযোগ তুলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দেন। দীর্ঘ টানাপড়েনের পর স্থানীয় সময় রাত ৮টার পরে নির্বাচন কমিশন নন্দীগ্রামে ভোট পুনঃগণনা না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওই আসনে শুভেন্দুকে বিজয়ী ঘোষণা করে। ওই সময়ে শুভেন্দু এক টুইটে ভোটের চূড়ান্ত রাউন্ডের গণনার ‘টেবুলেশন শিট’ পোস্ট করে নিজের বিজয় দাবি করেন। ওই শিট অনুযায়ী মমতার থেকে তিনি এক হাজার ৭৩৬ ভোট বেশি পেয়েছেন। এক লাখ নয় হাজার ৬৭৩ ভোট পেয়েছেন শুভেন্দু। মমতা পেয়েছেন এক লাখ সাত হাজার ৯৩৭ ভোট। ২০১৬ সালে মমতার দল তৃণমূলের হয়ে নন্দীগ্রাম আসনে জিতেছিলেন শুভেন্দু। গত বছর ডিসেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। এবার ভোটের আগে মমতাকে হারানোর চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন শুভেন্দু। তৃণমূলনেত্রী কলকাতায় নিজের আসন ছেড়ে নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণও করেন।
হেরে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন? : বিধানসভা নির্বাচনে বড় জয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের টানা তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হলেও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। নন্দীগ্রামে নিজের আসনে তৃণমূল নেত্রী মমতার হেরে যাওয়ার খবর আসায় প্রশ্ন উঠেছে, দল সরকার গঠন করলে তিনি কি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন? ভারতীয় সংবিধানের ১৬৩ ও ১৬৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশটির কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে হলে তাকে ভারতের নাগরিক হতে হবে এবং বয়স হতে হবে ২৫ বা তার বেশি। তাকে রাজ্যের বিধানসভার সদস্য হতে হবে। আর বিধানসভার সদস্য না হয়েও কেউ যদি মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেন, তাকে রাজ্যপালের অনুমতি নিতে হবে। কেউ হেরে যাওয়ার পরও তার দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং দলের নির্বাচিত সদস্যরা যদি তাকে নেতা নির্বাচিত করেন, তাহলে তার মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে ভোটে না জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হলে তাকে ওই পদে বসার ১৮০ দিনের মধ্যে কোনো একটি আসন থেকে জিতে আসতে হবে। তা না পারলে ছেড়ে দিতে হবে পদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদোষ না করেও দেড় বছর ধরে কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধশারুনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ মুনিয়ার ভাইয়ের