নতুন বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ রক্ষায় সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি জানান, ঢাকার খালগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করতে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। স্থানীয় সরকার, পানিসম্পদ, ভূমি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলবে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) এই গ্রুপের আহ্বায়ক করা হয়েছে। এই ওয়ার্কিং গ্রুপে পানি উন্নয়ন বোর্ড, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী রক্ষা কমিশন এবং সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা একটি কর্মশালার মাধ্যমে প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে এবং চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বন সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশ সুরক্ষায় ইতিবাচক উদ্যোগগুলো চালু রেখে যেতে চায় সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যুবসমাজ পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
গত ৭ নভেম্বর রাজধানীর পানিভবনে ‘নতুন বাংলাদেশে পরিবেশ, জলবায়ু ও রাজনীতি’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন। সেমিনারে দেশজুড়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। শুধু ঢাকার নদী–খাল নয়, দেশের প্রতিটি নদী–খালকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
অবশ্য এর আগের দিনেই সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, নদী ও খাল দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। এসময়ে যে কাজটা আমরা করতে পারবো অন্য সময়ে সে কাজটা অনেক স্লো হয়ে যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্ট এবং ক্রসবার–৩ এলাকা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, আমাদের বাজেটের তুলনায় নদী ভাঙনের প্রবণতা এবং ব্যাপকতা অনেক বেশি। আর তাই আগামীতে যে রিসোর্স বা বাজেট এই মন্ত্রণালয় পাবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেসকল জেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা দরকার সে সকল জেলায় সুষম বণ্টন করা হবে এবং কেউ যেন মনে না করে যে তার এলাকা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, নদীতে যেসকল নতুন চর জেগে ওঠে সেখানে ভূমিহীনদের জায়গা দেয়া এবং বনায়নের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমাদের সকলকে ভাবা উচিত। নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরে শিল্প স্থাপন করতে দেয়া হলে নদী যে দূষণ হয় এ বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে আমরা কর্ণফুলীর কথা বলতে পারি। চট্টগ্রামের নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে কর্ণফুলীকে বাঁচানোর জন্য নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আন্দোলনকারীদের দাবি, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে যেসব বেসরকারি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। খালগুলো দিয়ে যাতে গৃহস্থালি বর্জ্য, পলিথিন নদীতে পড়তে না পারে, বেলে মাটির পাহাড় বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাতে নদীতে পলি জমতে না পারে সে জন্য মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সিলট্রেপ তৈরি করতে হবে। তাঁরা বলেন, নদী জীবন্ত সত্তা। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন চিকিৎসা দরকার তেমনি নদীরও শাসন, পরিচর্যা দরকার। কর্ণফুলী এখন মুমূর্ষু, বিপন্ন, অরক্ষিত। বড় সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস হলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ এ নগরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই জরিপ অনুযায়ী নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। দখলকৃত জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। সেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
পরিবেশ আজ বড়ই বিপন্ন। ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানবজীবনও হুমকিতে পড়েছে। পরিণামে জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে পরিবেশ শরণার্থীর সংখ্যা। পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ দূষণের শিকার সচেতন জনগণের মতে, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা না করা, খাল–নদী দখল, কল–কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও পোড়া জ্বালানি, কালো ধোয়া, কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা, বস্তির উদ্ভব, ঘনবসতি, ধূমপান, পানিতে মলমূত্র ও মৃত প্রাণীদেহ ফেলা, আর্সেনিক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, গাড়ির হর্ণ ও মিলকারখানার শব্দ এবং অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সর্বোপরি আইন অমান্য করা ও দেশপ্রেমের অভাবই পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে। তাই নদী ও খাল দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশ বাঁচানো জরুরি।