১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধকালে নৌ কমান্ডোরা যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তা রচিত হয়েছিল কর্ণফুলী নদীর বুকে। ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামের এই অভিযানে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে দিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’ এর বার্তা। এই নদীকে ঘিরে রচিত হয়েছে হাজারো গান কবিতা। বিদ্রোহী কবি নজরুল ১৯২৫ মতান্তরে ১৯২৬ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম আসেন। সেই সময়ে বন্ধু হাবীবুল্লাহ বাহার সহ অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে সদরঘাটের সাম্পান ঘাটে নদী ভ্রমণের জন্য সাম্পানে উঠেছিলেন। কিন্ত সাম্পানটিতে এতো জনবল নেয়ার ক্ষমতা না থাকায় কবি একাই সেই সাম্পানে ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেই বিখ্যাত গান ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙ্গা আমার তরী’ রচনা করেছিলেন। আবার সেই কর্ণফুলী নদীতেই ১৯৬১ সালে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই কর্ণফুলীর বুক চিরে খুলছে দেশের আরেকটি স্বর্ণ দুয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ঙহব পরঃু ঃড়ি ঞড়হি’ হিসেবে গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে নদীর দুই পাড়ে দুইটি শহর। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এন্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এই কাজটি করছে যার ৮৭ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। স্বপ্ন যিনি দেখাতে জানেন বাস্তবায়নও তিনি করেন যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যখন তিনি টানেলের কথা বলেছিলেন তখন আমাদের সক্ষমতা কম ছিল। কিন্ত তিনি জানতেন সক্ষমতা অর্জন করতে হয়, যা তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু একটি দেশ স্বাধীন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আগামী ডিসেম্বর ২০২২ এই টানেল চালু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
২০১৩ সালে টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা সম্পন্ন করে চায়না কমিউনেকেশন এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি। ২০১৫ সালের ৩০ জুন চীনের সাথে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল মির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ১৪অক্টোবর প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন এবং ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। ১০৩৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে ৪৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ, বাকি টাকা চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিয়েছে। টানেলের দৈর্ঘ ৩.৩২ কিলোমিটার। টানেলটিতে থাকছে দুইটি টিউব যেগুলোর মধ্যে যানবাহন চলাচল করবে। দুইটি টিউবের নির্মাণ বা খনন কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের ভাস্য মতে টিউব দুইটির নির্মাণ কাজ ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। প্রথম টিউব নির্মাণে সময় ব্যয় হয় ১৭ মাস, দ্বিতীয় টিউব নির্মাণ করতে সময় ব্যয় হয়েছে ১০ মাস। তাঁর মতে এই টিউবগুলোয় ৬ টি সিস্টেম আছে যা খুবই জটিল এবং স্পর্শকাতর। তাই এটি খুলে দেয়ার আগে প্রি কমিশনিং করে দেখতে হবে। এটি গতানুগতিক কোনো সেতু বা প্রকল্প নয়। কর্ণফুলী নদীর উপর দুইটি সেতু আছে যা প্রচুর যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে নদীর মরফজিকেল বৈশিষ্ট অনুযায়ী জোয়ার ভাটায় নদীর তলদেশে পলিমাটি জমা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বড় হুমকি। তাই নদীর তলদেশে অত্যাধুনিক এই টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৫.৪৫ সংযোগ সড়কের এই টানেলের টিউব দুটির গভীরতা ১৮-৩১ মিটার, ৩৫ ফুট প্রসস্থ ও ১৬ ফুট উচ্চতা। টানেলের ভিতরে ৪টি লেন থাকবে। ২১০ জন চীনের ও ৮০০ জন বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত শ্রমিক এই টানেল নির্মাণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে যদিও কোভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারী কালে যৌক্তিক কারণে কাজের গতি শ্লথ ছিল।
চট্টগ্রাম শহর প্রান্তের পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশ থেকে শুরু হওয়া এই টানেল কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানা এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। নদীর মধ্যভাগে টানেল অবস্থান ১৫০ ফুট গভীরে। টানেলের পাশাপাশি ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। ৮০কিলোমিটার গতিতে (প্রায়) যান চলাচল করবে এই টানেল দিয়ে যার ফলে চট্টগ্রাম শহরে ট্রাফিক চাপ অনেকাংশে কমে যাবে, তবে আউটার রিং রোডগুলোর কাজ খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। টানেলের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ইতিমধ্যেই দুই প্রান্তে দুটি থানার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ।
টানেলের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। পরবর্তী চার বছর এই দায়িত্ব পালন করবে তারা।
বঙ্গবন্ধু টানেল ভবিষ্যতের অর্থনীতির স্বর্ণ দুয়ার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই টানেল চালু হলে ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজার জাতীয় মহাসড়কের উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের প্রসার, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এর সাথে যুক্ত হওয়া, চট্টগ্রাম শহরে যুগোপযোগী সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নদীর পূর্ব পাড় ঘেষে গড়ে ওঠা ডাউন টাউনকে যুক্ত করে উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল, আনোয়ারা শিল্পাঞ্চল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, বন্দর বে টার্মিনালকে সংযুক্ত করে এবং চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে গড়ে ওঠা এই টানেল অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কর্মচাঞ্চল্য আরো বেগবান হবে। শুধু তাই নয় এই টানেল নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব আসবে। অর্থনীতিবিদদের মতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ফাইনান্সিয়াল ও ইকনমিক ইন্টারনেল রেইট অব রিটার্ন (আই আর আর) এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ ও ১২.৪৯ শতাংশ।
পদ্মা সেতুর চমকের পর আরেকটি নতুন চমক নতুন ইতিহাস বিনির্মাণের পথে বাংলাদেশ। সার্থক হবে সাম্পান খ্যাত কর্ণফুলীর সেই বিখ্যাত গান ‘ওরে সাম্পান ওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা’। প্রেমিককে কাছে পাওয়ার জন্য প্রেয়সীর আহাজারি থেমে যাবে। এই যুগে জন্ম হলে জাতীয় কবিকেও লিখতে হতোনা ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙ্গা আমার তরী’, হয়তো তিনি লিখতেন ‘চলো এক সাথে জয় বাংলার রথে’।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক